• কাশ্মীরে ‘জৈশ’ পোস্টার দেখে অপারেশন শুরু, দিল্লির বিস্ফোরণের টাইমলাইন, কোন পথে ছুটেছেন গোয়েন্দারা?
    এই সময় | ১২ নভেম্বর ২০২৫
  • পহেলগামের ঘা এখনও দগদগে। এপ্রিল মাসের পর থেকেই দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলির শ্যেন দৃষ্টি ছিল সীমান্তবর্তী এলাকায়। জঙ্গি নিধনে কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে সেনাবাহিনীর অভিযান চলছিল নিয়মিত। দিল্লির ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, বিপদ ওঁত পেতে বসেছিল ঘরের ভেতরেই। সম্প্রতি একই বছরের মধ্যে পরপর দু’বার দেশে সন্ত্রাসবাদী হামলার উদাহরণ নেই। এ বার রক্তাক্ত রাজধানী। মৃত্যু ১৩ জনের। ধ্বংসাত্মক চিত্রনাট্য লেখাটা শুরুটা হয়েছিল সেই কাশ্মীর থেকেই।

    চলতি বছরের ১৮ অক্টোবর। শ্রীনগরের নওগাম এলাকায় কয়েকটি পোস্টার নাড়িয়ে দিয়েছিল স্থানীয় প্রশাসন ও বাসিন্দাদের। মাত্র ছয় মাস আগেই পাকিস্তানের বাহওয়ালপুরে জৈশ-ই-মহম্মদের হেড কোয়ার্টার ‘মারকাজ সুভানাল্লাহ’ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল অপারেশন সিঁদুরে। সেই সংগঠনের নামেই ছিল পোস্টার। তাতে লেখা— জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে মোক্ষম জবাব দেওয়া হবে। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর থেকেই এই ধরনের পোস্টারিং অনেকটাই কমে এসেছিল ভূ-স্বর্গ জুড়ে। নতুন করে এই ধরনের পোস্টার কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়ে ছিল গোয়েন্দাদের। শুরু হয় খোঁজখবর নেওয়া।

    পুলিশের কর্তারা জম্মু-কাশ্মীরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহার সঙ্গে পরামর্শ করে তদন্তে নামেন। শ্রীনগরের এসএসপি সন্দীপ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ পোস্টারদাতার খোঁজ শুরু করে। ১৯ অক্টোবর অজ্ঞাতপরিচয় লোকজনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়। নওগাম এলাকার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তিন যুবক পোস্টার সাঁটাচ্ছেন। তারা হলো আরিফ নিসার দার ওরফে সাহিল, ইয়াসির-উল-আশরাফ এবং মাকসুদ আহমেদ দার। প্রত্যেকেই নওগামের বাসিন্দা। কাশ্মীরে ‘পাথর ছোড়া’য় স্পেশালিস্ট ছিল ওই যুবকের দল। কিন্তু পোস্টার সাঁটাতে বলল কে?

    পাকিস্তানি হ্যান্ডলারের নির্দেশে পোস্টার সাঁটাতে বলেছিলেন মৌলবি ইরফান আহমেদ। তিনি আলি নাকিবাগ মসজিদের ইমাম ছিলেন। এই ইরফানের সঙ্গে জঙ্গি যোগের তালিকা লম্বা। এলাকায় পরিচিত ওই ইমাম মূলত জঙ্গিদের অস্ত্র সরবরাহে সাহায্য করতেন। জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের জন্য কাশ্মীরি যুবকদের পাকিস্তানেও পাঠিয়েছিলেন। এই মৌলবির কাছ থেকেই জানা যায় ডাঃ আদিলের নাম। মৌলবির সঙ্গে আদিলের দেখা হয় অনন্তনাগে। হামলার ছক কষা শুরু সেই থেকেই। মৌলবির থেকে জানা যায়, আরও এক জেহাদি জামির আহমেদের নাম।

    জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ জামির আহমেদ আহংগারকে (গান্ডারবালের বাসিন্দা) গ্রেপ্তার করে। শুরু হয় ডাঃ আদিলের খোঁজ। আদিল ততদিনে অনন্তনাগ ছেড়ে উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুরের একটি হাসপাতালে কর্মরত। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের জঙ্গিদমন শাখার অফিসাররা ডাঃ আদিলকে গ্রেপ্তার করেন। আদিলের থেকে খোঁজ মেলে ডাঃ মুজাম্মিল আহমেদ গনাই ওরফে মুসাইবের। হরিয়ানার ফরিদাবাদের আল-ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তার হিসেবে কর্মরত ছিলেন ডাঃ মুজাম্মিল আহমেদ। এই মুজাম্মিল সরকারি মেডিক্যাল কলেজের একটি লকারে একটি AK-56 রাইফেল লুকিয়ে রেখেছিলেন বলে অভিযোগ। যা পরে পুলিশ উদ্ধার করে।

    ডাঃ মুজাম্মিল আহমেদকে জেরা করেই এগোতে থাকে তদন্ত। পুলিশের জেরায় জানা যায়, ফরিদাবাদে একটি গোপন আস্তানায় লুকনো রয়েছে প্রচুর বিস্ফোরক। প্রচুর পরিমাণে IED তৈরির জন্য উপকরণ এবং সরঞ্জাম মজুদ করেছিলেন ডাঃ মুজাম্মিল আহমেদ। ছিল ৩৫৮ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক, ডেটোনেটর এবং অন্যান্য ডিভাইস। পরিকল্পনা ছিল দেশে বড় কোনও নাশকতা ঘটানোর।

    লখনৌয়ের বাসিন্দা শাহিনও আল-ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মুজাম্মিলের সহকর্মী এবং বান্ধবী। মুজাম্মিলের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে শাহিনের কানে। মহিলা ডাক্তার তাঁর প্রেমিকের গ্রেপ্তারের কথা জানতে পেরে গাড়িতে লুকানো AK-47 ফেলে দেন আল-ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনে একটি ডাম্পিং সাইটে। শেষরক্ষা হয়নি। ডাঃ শাহিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ডাম্পিং সাইট থেকে AK-47 উদ্ধার হয়।

    একের পর এক ‘লিঙ্কম্যান’ হাতে এলেও বিস্ফোরক কোথায় মজুত করা রয়েছে, তার জন্যে হন্যে হয়ে খোঁজ চালাচ্ছিলেন তদন্তকারীরা। এত পরিমাণ বিস্ফোরক কোনওভাবে ব্যবহার হয়ে গেলে মৃত্যুমিছিল হতো দেশে। মুজাম্মিলকে চাপ দিয়েই তদন্তকারীরা জানতে পারেন সিঙ্গার-পুনহানা গ্রামের বাসিন্দা হাজি ইশতিয়াক নামে এক জিহাদি ষড়যন্ত্রকারীর নাম। ফরিদাবাদে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন এই ইশতিয়াক। সেই বাড়িতেই ছিল পাহাড় প্রমাণ বিস্ফোরক। ৮৮টি বস্তায় মোট ২৫৬৩ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক পদার্থ উদ্ধার হয়। ইশতিয়াকের গোপন একটি আস্তানা ছিল আল-ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনেও। এই আস্তানায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, পটাশিয়াম, জ্বালানি তেল, ডেটোনেটর, ব্যাটারি এবং টাইমার উদ্ধার হয়।

    ডাঃ আদিল, ডাঃ মুজাম্মিল এবং ডাঃ শাহিনকে একযোগে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন তদন্তকারীরা। জেইএম-এর পাকিস্তানি হ্যান্ডলারদের নির্দেশে বড়সড় জঙ্গি হানার পরিকল্পনা করেছিল এই ‘ডক্টরর্স মডিউল’। লাগাতার জেরায় বেরিয়ে আসে ডাঃ উমরের নাম। নিজের সহযোগীদের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর শুনে ততক্ষণে পালাবার চেষ্টা শুরু করে ডাঃ উমর। জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ ডাঃ উমরকে গ্রেপ্তার করতে আল-ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে। জানা গিয়েছে, প্রায় ১২ দিন ধরে বিস্ফোরণে ব্যবহৃত গাড়িটি ছিল আল-ফালাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্কিং লটে। গাড়িটি নিয়ে ততক্ষণে লালকেল্লার দিকে রওনা দিয়েছে ডাঃ উমর। HR26CE7674 নম্বরের সাদা i20 গাড়ি গিয়ে দাঁড়ায় লালকেল্লায় মেট্রোর এক নামবে গেটের কাছে সিগন্যালের সামনে। সম্ভবত বিস্ফোরক নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার আগেই ঘটে যায় প্রচণ্ড বিস্ফোরণ।

  • Link to this news (এই সময়)