‘উপেক্ষিত’ বাবা-মায়ের খোঁজ নিতে বৃদ্ধাশ্রমে ভিড় ‘সচেতন’ সন্তানদের, আসলে নথির টান!
আনন্দবাজার | ১২ নভেম্বর ২০২৫
ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন, সংক্ষেপে এসআইআর। এর সৌজন্যে গত কয়েক দিন ধরে নানা অভূতপূর্ব ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে বাংলা। কোথাও নথির টানে তিন দশক পরে স্ত্রীর কাছে ফিরছেন বৃদ্ধ, কোথাও নথি জোগাড়ের চিন্তায় আত্মহত্যাও করে ফেলছেন বলে অভিযোগ। এসআইআরের জন্য তেমনই এক অভিনব ঘটনা ঘটল নদিয়ায়। সংসারে অপাংক্তেয়, অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাঁদের ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে, সেই প্রবীণদের কাছে হঠাৎ সন্তানদের ভিড় শুরু হয়েছে। ভালবাসার টানে নয়, এসআইআরের জন্য নথির স্বার্থে।
নদিয়ার রানাঘাটের পুরাতন চাপড়া এলাকায় রয়েছে জগদীশ মেমোরিয়াল বৃদ্ধাশ্রম। নদিয়া, বর্ধমান এমনকি, হালে কলকাতা থেকেও বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এসে এখানে থাকছেন। এখন বৃদ্ধাশ্রমের সদস্য সংখ্যা কমবেশি ৪৪। ছুটির দিনে কারও কারও ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি দেখা করতে আসেন। কিন্তু গত কয়েক দিনে হঠাৎ করেই ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ বেড়ে গিয়েছে ওই বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমের সম্পাদক গৌরহরি সরকার জানালেন কারণ। তিনি বলেন, ‘‘এসআইআর চালু হওয়ার পর থেকেই হঠাৎ করে বাবা-মায়েদের সঙ্গে দেখা করার জন্য সন্তানদের আগ্রহ বেড়েছে। আগে যাঁদের দেখাই মিলত না, এখন তাঁরাই প্রায় প্রতিদিন বাবা-মাকে ফোন করছেন। কেউ কেউ চলেও আসছেন আশ্রমে।’’
গত পাঁচ বছর ধরে ওই বৃদ্ধাশ্রমে প্রবীণদের দেখাশোনা করছেন রুমা দেবনাথ। তাঁরও পর্যবেক্ষণ, ‘‘আগে অনেকে বাবা-মায়ের খোঁজও নিত না। সপ্তাহখানেক হল কেমন যেন বদলে গিয়েছে সব। এখন অনেকে এসেই জানতে চাইছে, বাবা-মা কেমন আছে, তাঁদের কিছু লাগবে কি না। কী হল কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে বাবুদের (আবাসিক) অনেকে মুচকি হেসে বলছেন, এসআইআর, এসআইআর।’’
শুধু নদিয়ার ওই বৃদ্ধাশ্রমই নয়, রাজ্যের অনেকে বৃদ্ধাশ্রমে একই ছবি দেখা যাচ্ছে গত ২৭ অক্টোবর এসআইআর ঘোষণার পরে। অনেকের কাছে এসআইআরের প্রয়োজনীয় নথি নেই। সে সবের জন্য বাবা-মায়ের কাছে ছুটছেন তাঁরা। এসআইআরের সৌজন্য হঠাৎ করে সন্তানদের কাছে যেন ‘মূল্যবান’ হয়ে উঠেছেন বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই পাওয়া বাবা-মায়েরা।
হঠাৎ জেগে ওঠা যত্নের আড়ালে যে স্বার্থের কটূ গন্ধ লুকিয়ে আছে, তা ওই প্রবীণ-প্রবীণারাও অস্বীকার করছেন না। তবে ভোটার তালিকায় বাবা-মায়ের নাম থাকা তো এখন সন্তানদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। কারণ তাতে জড়িয়ে রয়েছে তাঁদের ভবিষ্যৎ। আচমকা ছেলেমেয়েদের যাতায়াতে ওই বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকেরা মিশ্র অনুভূতি প্রকাশ করছেন। কেউ সন্তানের ফোন পেয়েই চোখের জলে ভাসছেন। তার পর চোখের দেখা পেলে তো কথাই নেই। শত হোক, সন্তান বলে কথা! কেউ কেউ জানেন সত্যিটা। তাঁরা নিঃশব্দে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তবে সকলেই চান, ছেলেমেয়ে যেন থাকে ‘দুধেভাতে।’ দিকে দিকে এসআইআর নিয়ে যে আতঙ্কের আবহ, তাতে প্রভাবিত হচ্ছেন তাঁরাও। এক আবাসিক বৃদ্ধার কথায়, ‘‘এই অবস্থায় সন্তানদের পাশে না থাকলে আর বাবা-মা হয়েছি কেন?’’ বলতে বলতেই শাড়ির খুঁটে চোখ মুছলেন তিনি। তার পর আরও বললেন, ‘‘নাড়ির টানে না-ই হোক, নথির টানে তো কাছে এল।’’