আমেরিকার কর্নেল ইউনিভার্সিটি দু’বছর আগে প্রস্তাব করেছিল, তাদের গবেষক ছাত্র-কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাবে। দুনিয়ার সব তালিকায় কর্নেল বিশ্বের কুড়িটি শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। সম্মান ছাড়াও এই বাবদ পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য যাদবপুরের কিছু অর্থাগম হত। দশ বছর আগে প্রস্তাবটি পত্রপাঠ গৃহীত হত। এ বার বাদ সাধল রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক বিধান— এমন প্রকল্পে এখন তাদের অনুমোদন লাগে। আবেদন-নিবেদন সত্ত্বেও বছর ঘুরে গেল, সেটা আর এল না। এল পরের বছর, তত দিনে আমেরিকার পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।
মূলধনের কাঙাল যাদবপুর চিরকাল এ ভাবেই ভবন, পরিকাঠামো, মেধার ভান্ডার গড়ে তুলেছে, দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই স্বাধীন বিচরণ বর্তমান শাসকদের না-পসন্দ। এই মুহূর্তে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যাদবপুরের অন্তত চোদ্দোটি গবেষণাচুক্তি অনুমোদনের অপেক্ষায়, সাতটি গত অর্থবর্ষ থেকে। বলা বাহুল্য, ওই প্রতিষ্ঠানগুলি আর যাদবপুরমুখো হবে না। তাতে কী, শিক্ষাঙ্গন আর শিক্ষককুলকে বশে রাখা গেল।
বঞ্চনার কাহিনিটা একমাত্রিক নয়। ভারতের সব রাজ্য-বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিশেষত বিরোধী-শাসিত রাজ্যে) আজ শনির দশা। কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রপোষিত, অধিকাংশ রাজ্য-সরকার পোষিত। কিন্তু বরাবর বোঝাপড়া ছিল, প্রত্যেকটিকেই উন্নয়ন আর সম্প্রসারণের প্রধান অর্থ দেশের সরকার জোগাবে। ইউজিসির অনেক প্রকল্প ছিল পরিকাঠামো গড়ার; আর অনেকগুলি গুণবর্ধক, যেমন ‘বিশেষ সাহায্য’ (স্পেশ্যাল অ্যাসিসট্যান্স) বা ‘উৎকর্ষের প্রতিশ্রুতি’ (পোটেনশিয়াল ফর এক্সেলেন্স) প্রকল্প। এখানে উৎকর্ষের প্রমাণ দেখিয়ে আরও উৎকর্ষ সাধনের টাকা জুটত, রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত। কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি পক্ষপাত বড় দেখিনি। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকেও ভাল টাকা জুটত। বই, যন্ত্র, ভবন, নতুন পদ সব কিছুর জন্য।
স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছরে দেশভর একটা ব্যাপক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল কেন্দ্র ও রাজ্যের এই সমন্বয়ে। গত দশ বছরে ছাঁচটাই পাল্টে গেছে। আজকের মার্গদর্শন, রাজ্য-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পুরোপুরি রাজ্যের বালাই, জাতীয় সরকার দায়মুক্ত। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পাট নেই, নেই ইউজিসির প্রায় কোনও অনুদান। যেটুকু কেন্দ্রীয় সাহায্য মেলে তা সরাসরি শিক্ষা মন্ত্রক থেকে, রাজনৈতিক রণকৌশলে ‘ওয়েপনাইজ়’ করে। কয়েক বছর আগে যাদবপুর-সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়নের জন্য ১০০ কোটি করে অনুদান পায়। ৪১ কোটি ছাড়ার পর টাকার জোগান অকস্মাৎ বিনা ব্যাখ্যায় বন্ধ হয়। ৪০টি গবেষণা প্রকল্প থমকে যায়, ২০০ কর্মী চাকরি খোয়ায়, বাড়িঘর অর্ধনির্মিত অবস্থায় পড়ে থাকে। ‘উৎকর্ষ-প্রতিষ্ঠান’ (ইনস্টিটিউট অব এক্সেলেন্স) প্রকল্পে যোগ্য বিবেচিত হয়েও ছিটকে যায় যাদবপুর আর তামিলনাড়ুর আন্না বিশ্ববিদ্যালয়।
দেশের ৭০ শতাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রাজ্য-পরিচালিত; সেগুলি কেন্দ্র কার্যত পরিত্যাগ করেছে। এ-দিকে অসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পসরা সাজিয়ে হাজির, সেগুলির শ্রীবৃদ্ধি কেন্দ্রীয় নীতির অঙ্গ। তবু যে-ক’টি রাজ্যের নিজের জোরে উৎকর্ষ বহাল রাখার ক্ষমতা আছে, তার একটি অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গ। শত বিপর্যয় সত্ত্বেও ‘নিছক’ লেখাপড়ার যেটুকু কদর আজও এখানে আছে তা অন্যত্র বিরল। বাংলার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান সর্বভারতীয় তালিকার উপরের দিকে (যাদবপুর এ বারও রাজ্য-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে প্রথম)। অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে বাংলায় বেশি ছেলেমেয়ে সরকার-পোষিত স্কুলে যায়, অর্থাৎ মেধাসম্পদের বৃহত্তম অংশ সরাসরি সরকারি ব্যবস্থার আওতায়।
রত্নগর্ভা রাজ্যের মেধার সদ্ব্যবহার করতে কিন্তু রাজ্যের কোনও চাড় নেই। অর্থাভাব এর একমাত্র কারণ নয়। যা টাকা কুড়িয়ে-বাড়িয়ে জোগাড় হয় তার অজস্র দাবিদার, ভোটমূল্য যাদের ঢের বেশি। উচ্চশিক্ষার বাঁধা বরাদ্দটুকুও বহু বছর মিলছে না। (স্কুলশিক্ষার হালও শোচনীয় এবং সমান চিন্তাকর, তবে সেটা অন্য গল্প।) যাদবপুরের গ্রন্থাগারে গত সাত বছর একটাও বই কেনা যায়নি। অত্যাবশ্যক ডেটাবেস স্তব্ধ। গবেষণাগারের খরচে ৪০ শতাংশ ছাঁটাই। শিক্ষকপদের এক-তৃতীয়াংশ খালি, আধিকারিকদের প্রায় প্রতিটি। ঘুরেফিরে একই হাল রাজ্যের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের।
অভাব লাঘবের একটা উপায় হতে পারত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গবেষণা-চুক্তি। বিধিনিষেধের ফলে সে রাস্তা কণ্টকিত। বিদেশি সহযোগের ব্যাপারে কেন্দ্রের কড়াকড়ি ভীতিপ্রদ পর্যায়ে পৌঁছেছে। দেশি-বিদেশি সব সহযোগেই সরকারের সম্মতি চাই, আর প্রায়ই তা দূর অস্ত্।
গত কয়েক বছরে রাজ্য প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। কর্মসমিতির মিটিং ডাকতে সরকারের অনুমতি লাগে, লাগে ছাত্র সংসদের নির্বাচন করাতে। তামাম দুনিয়ার প্রচলন ভেঙে ডিন নির্বাচন করে সরকার। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাক্স্বাধীনতা ও মুক্ত চিন্তা আজ বিপন্ন। রাজ্যগুলিরও সাধ সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করতে। বাংলায় তার চেষ্টা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি (স্ট্যাটিউটস) খোলনলচে পাল্টে। শিক্ষক সমাজের প্রতিরোধে সেটা সম্ভব হয়নি। ফলে অবিশ্বাস্য ভাবে সে সব ছাড়াই রাজ্যের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এগারো বছর চলছে।
আজ শিক্ষা-রাজনীতি আর ছাত্র বা শিক্ষকদের কাঁচা হাতের ছেলেখেলা নয়। কেন্দ্র ও রাজ্যের শীর্ষ কর্তারা শিক্ষাঙ্গনগুলি করে তুলেছেন উচ্চপর্যায়ের রাজনীতির আখড়া। কেরল, তামিলনাড়ুর পাশাপাশি এ রাজ্যেও বছরের পর বছর উপাচার্য নিয়োগ আটকে থেকেছে সরকার আর রাজ্যপালের পাঞ্জার লড়াইয়ে। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টকে কমিটি বসিয়ে কাজটা করাতে হয়েছে। অর্ধেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জুটেছে দেড় বছর বাদে, কলকাতা ও যাদবপুর-সহ আরও কয়েকটির আড়াই বছরে। পাঁচটির ভাগ্য এখনও ঝুলে।
উপাচার্যের অভাবে পদে পদে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটে, অর্ধাহারে থাকলে যেমন মানুষের সঞ্চিত শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসে। আপাত সহজ কাজগুলি দুঃসাধ্য, কখনও বা আইনত অসম্ভব হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি, শিক্ষক নিয়োগ থমকে যায়। ছাত্রস্বার্থের এই চরম হানি বিশ্ববিদ্যালয়েরই আচার্য তথা সর্বোচ্চ শিক্ষাকর্তারা আড়াই বছর প্রলম্বিত করেছেন। এ বার কি আশা করা যায়, ক্ষতিটা পূরণ করতে উভয়ে যথাকর্তব্য পালন করবেন?
তার জন্য ম্যাজিক দেখাতে হবে না, অভ্যস্ত কাঠামো ও বিধি-বরাদ্দ ফিরিয়ে আনলেই অনেকটা সমাধান হবে। শিক্ষক-অশিক্ষক সব পদে নিয়োগ হোক। যে রুটিন অনুদান একদা রুটিন মেনেই আসত অন্তত সেটুকু নিশ্চিত হোক। এই দুই খাতে টাকা বাঁচিয়ে অর্থক্লিষ্ট সরকারের নিশ্চয় কিছু সাশ্রয় হচ্ছে, জনমোহিনী বা যথার্থ জনহিতকর নানা কাজের জন্য। কিন্তু শিক্ষা যে ব্যয়সঙ্কোচনের উপযুক্ত ক্ষেত্র নয়, এটাও আজ বলার সময় এসেছে। কেন্দ্রীয় সরকারকে মনে হয় বলা নিষ্ফল। রাজ্য সরকার নিজেদের উদ্যোগে আর পাঁচটা ভাল কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, এটাও সেই তালিকায় যোগ হোক।
আর যে পদক্ষেপ না হলেই নয়, তাতে কোনও খরচ লাগবে না, কিচ্ছু করতে হবে না, বরং কর্তাদের শ্রম লাঘব হবে। সেটা হল বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে স্বাধীন পরিচালনক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া, আর তার অঙ্গ হিসাবে শিক্ষককুলকে যথাযোগ্য স্থান দিয়ে স্ট্যাটিউটস চালু করা। এটা কিন্তু নন-নেগোশিয়েবল, এখানে আপস অসম্ভব। প্রশাসনের ছন্দ আর শিক্ষাকাণ্ডের, বিশেষত গবেষণার, ছন্দ আলাদা, পারস্পরিক সংযোগের ধাঁচ আলাদা। শিক্ষককুলকে দূরে রেখে বিধি জারি করা ব্যর্থ হতে বাধ্য, কারণ শিক্ষাপ্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি তাঁরাই বোঝেন।
এখন রাজ্যে একগুচ্ছ নতুন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে, যার অবস্থা ও অবস্থান সম্পূর্ণ আলাদা। এগুলি নিয়ে একেবারে আলাদা আলোচনা একান্ত প্রয়োজন। নইলে রাজ্যের চিরস্থায়ী অর্থসঙ্কটে এবং শিক্ষাজনিত টানাপড়েনে এগুলি বিপর্যস্ত হয়ে যাবে।
সমাজের সব ক্ষেত্রের মধ্যে শিক্ষা নিয়েই সদর্থক চর্চা সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশিত। আজ কেন্দ্রের তরফে যে চর্চা চলছে তা সদর্থক বলা কঠিন। রাজ্যের তরফে কোনও চর্চাই নেই। রাজ্যে শিক্ষার বাঁধুনি আলগা হয়ে এসেছে। রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক মুঠোয় নয়, শিক্ষাদরদি হাতে রাশ টানা একান্ত প্রয়োজন।
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়