• অদৃশ্য শ্রমিককে দৃশ্যমান করা
    আনন্দবাজার | ১২ নভেম্বর ২০২৫
  • মৌমিতা চক্রবর্তী

    মেয়েরা যাতে স্বাধীন ভাবে রোজগার করতে পারেন, কর্মীর মর্যাদা পেতে পারেন, তার জন্য দীর্ঘ লড়াই এবং অসামান্য নানা উদ্যোগের স্বাক্ষর রেখে এলা ভাট (ছবি) বিদায় নিয়েছিলেন ২ নভেম্বর, ২০২২-এ। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক নারীদের জন্য তাঁর অবদানকে মনে রেখে আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘আইইউএফ’ তাঁর প্রয়াণ দিবসটিকে ‘অসংগঠিত শ্রমিক দিবস’ বলে গ্রহণ করে। প্রস্তাবটি গৃহীত হয় ১৬ জুন, ২০২৩, জেনিভায়। খাদ্য, কৃষি, পর্যটন প্রভৃতি কর্মক্ষেত্রের কর্মী সংগঠনগুলির আন্তর্জাতিক মঞ্চ আইইউএফ-এর কার্যনির্বাহী কমিটির সেই সভায় উপস্থিত ছিল ১২৬টি দেশের সদস্য সংগঠন। উদ্দেশ্য, বিশ্ব জুড়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের কণ্ঠ, দৃশ্যমানতা এবং স্বীকৃতি দাবি করা। এ বছর এই দিনটি পালন করা হল গুজরাতে, এলা ভাট-প্রতিষ্ঠিত ‘সেল্ফ এমপ্লয়েড উইমেন’স অ্যাসোসিয়েশন’-এর (সেওয়া) প্রধান দফতরে।

    ভারত-সহ অনেক দেশেই রোজগেরে মানুষের বৃহত্তর অংশ অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত। সমাজ ও অর্থনীতিতে তাঁদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাঁদের কাজের যথাযথ স্বীকৃতি তাঁরা পান না, নিরাপত্তা পান যৎসামান্য, অথবা শূন্য। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক মেয়েরা, বিশেষত স্বনিযুক্ত মেয়েদের অবস্থা সবচেয়ে কঠিন। এই মেয়েদের নিয়েই সারা জীবন কাজ করেছেন এলা ভাট। গান্ধীজির আদর্শে অনুপ্রাণিত এলা কাপড়কলের শ্রমিকদের সংগঠন ‘টিএলএ’-র আইনজীবী হিসেবে কাজ করতেন।

    এক দিন, ১৯৭০-৭১ সালের দিকে, তিনি দেখলেন এক দম্পতি নিজেদের বাড়ির গরুর দুধ ঠেলাগাড়িতে করে বিভিন্ন হোটেলে বিক্রি করছেন। পুলিশের নির্দেশে তাঁরা একটি ট্র্যাফিক সিগন্যালে থেমে হঠাৎ দুর্ঘটনার মুখে পড়েন। তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্ষতিপূরণ আদায়ের উদ্দেশ্যে আদালতে মামলা হয়। কিন্তু ক্ষতিপূরণের টাকা দেবে কে? তাঁদের তো কোনও নির্দিষ্ট মালিক নেই। শেষে টাকার অভাবে চিকিৎসা হল না।

    এলার মনে প্রশ্ন জাগল, এই দম্পতি কী ভাবে সংসার চালাচ্ছেন? সিনিয়র আইনজীবী বলেন, “নিজে গিয়ে দেখে আসুন।” এলা বেন (গুজরাতে মেয়েদের নামের সঙ্গে ‘বেন’ কথাটা জোড়া হয়) সেটাই করলেন— তিনি নিজে গেলেন ওই দম্পতির বাড়ি। ১৯৭১ সাল— দুর্ঘটনাগ্রস্ত দম্পতির গ্রামে তখন জনগণনার সমীক্ষক এসেছেন। এলা বেনের কৌতূহল হল, গরুর দুধ বিক্রির কাজটা কী ভাবে নথিভুক্ত হচ্ছে? তিনি ‘সার্ভে ফর্ম’ দেখতে চাইলেন। তাতে লেখা ছিল, ‘নো ওয়ার্ক’ (কোনও কাজ করে না)। ডেয়ারি শিল্প দেশের জিডিপি বাড়াচ্ছে, কিন্তু যিনি দুধ নিষ্কাশন করছেন তাঁর কাজের স্বীকৃতি নেই, উপলব্ধি করলেন এলা বেন।

    অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মানুষদের উন্নতি করতে হলে সংগ্রাম যেমন চাই, তেমনই সংগঠনের মাধ্যমে এগোনোর রাস্তাও খুঁজে নিতে হবে, মনে করতেন এলা। তাঁর মতে, কোনও কার্যক্রমকে শক্তিশালী করতে তিন বছর লাগে, সংগঠনকে স্থায়ী ভাবে গড়ে তুলতে বিশ বছর লাগে, এবং কোনও আন্দোলনকে মজবুত করতে আরও বিশ বছর লাগে। গান্ধীর মতো তিনিও মনে করতেন, পরিবর্তন চাইলে সবার আগে নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে।

    পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত, অসংগঠিত শ্রমিকদের স্বীকৃতি মিলেছে কতটা? সামাজিক সুরক্ষা বিধি (২০২০) অনুযায়ী মাতৃত্বকালীন সুবিধা কেবল সেই সব নথিভুক্ত কারখানা, খনি, বাগান এবং দোকান ও প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য, যেখানে ১০ জন বা তার বেশি শ্রমিক কাজ করেন। তাতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের অধিকাংশ শ্রমিক, বিশেষত মেয়েরা, এই সুবিধাগুলোর আওতায় থাকবে না। গৃহপরিচারিকা, খেতমজুর, এবং বিড়ি শ্রমিক, যে সব ক্ষেত্রে অধিকাংশ কর্মী মহিলা, তাঁদের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক বলে ধরা হয়েছে কি না, তা-ও স্পষ্ট নয় চারটি শ্রম বিধিতে। কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের মজুরি-ভিত্তিক শ্রমিক হিসেবে ধরা হয়েছে। স্বনিযুক্ত কর্মী এবং গিগ কর্মীদের সংজ্ঞা, এবং এই দু’টি ক্ষেত্রের কর্মীদের মধ্যে পার্থক্যও বিধিতে স্পষ্ট ভাবে দেখানো হয়নি।

    অসংগঠিত শ্রমিকদের পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কর্মস্থলের পরিবেশ বিধির (২০২০) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আইন কিংবা প্রশাসনিক বিধি-ব্যবস্থা থাকলেও বিড়ি শ্রমিক, তাঁতি, আবর্জনা সংগ্রহকারী শ্রমিকরা তাঁদের পেশার কারণে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসার সুবিধা পাচ্ছেন না। মুর্শিদাবাদে বিড়ি শ্রমিকের সংখ্যা ১৮ লক্ষ, অথচ ধুলিয়ানে একটিমাত্র বিড়ি শ্রমিক হাসপাতাল রয়েছে। অনেক জায়গায় বিড়ি শ্রমিকরা এত দূরে যাওয়ার খরচ, সময় দিতে পারেন না। মোবাইল মেডিক্যাল ভ্যান থাকলেও বাজেটে তার বরাদ্দ নেই। সম্প্রতি কয়েকটি ব্লকে বিড়ি শ্রমিকদের একটি স্বাস্থ্য-সমীক্ষা করা হয়। দেখা যায়, ৪০-৫৫ শতাংশ শ্রমিক ঘাড়ে ব্যথা, ৬০-৭০ শতাংশ শ্রমিক পিঠের ব্যথায় ভুগছেন। ৬০ শতাংশের দৃষ্টি ঝাপসা, ৪০ শতাংশ ভুগছেন রক্তাল্পতায়।

    একটি দিবস পালন করলেই সমস্যার কূল পাওয়া যায় না। তবে যে শ্রমিকরা থাকেন প্রশাসনের, সমাজের দৃষ্টির আড়ালে, তাঁদের জন্য একটি দিন ধার্য করলে কিছু তথ্য, কিছু কণ্ঠ, সামনে আনা যায়। স্মরণ করা যায় এমন এক জনকে যিনি এই ‘অদৃশ্য’ শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদাকে রেখেছিলেন নিজের ভাবনা ও কাজের কেন্দ্রে।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)