সিসি ক্যামেরা সারানো হয়েছে। বেসরকারি সংস্থার বাছা বাছা নিরাপত্তাকর্মী নিযুক্ত হয়েছেন। নির্দিষ্ট পোশাক পরে তবেই তাঁদের কাজে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নিরাপত্তাকর্মীদের সচিত্র পরিচয়পত্রও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যা আগের মতোই, তা হল, হাসপাতালের ভিতরে বহিরাগতদের অবাধ প্রবেশ।
অথচ, দিন পনেরো আগেই পর পর উলুবেড়িয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসককে নিগ্রহ এবং এসএসকেএম হাসপাতালে নাবালিকা রোগীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরে কাছাকাছি সময়ে এই দুই ঘটনা ফের সরকারি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন, ‘‘বার বার একটি ক্ষেত্র নিয়েই কেন কথা উঠছে?’’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর পরেই মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ এবং সমস্ত মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, সুপারদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন। রাজ্যের সমস্ত জেলার জেলাশাসক, পুলিশ সুপার এবং সমস্ত পুলিশ কমিশনারেটের কমিশনারেরাও সেখানে ছিলেন। সেই বৈঠক থেকেই হাসপাতালের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য এক গুচ্ছ নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই নিরাপত্তার চেহারাটা কতটা বদলেছে, দেখতে যাওয়া হয়েছিল এসএসকেএম হাসপাতালে। দেখা গেল, নির্দেশ মানাই সার। নিরাপত্তার ব্যবস্থা বলতে তৈরি হয়েছে ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’।
কারণ দেখা গেল, হাসপাতাল জুড়ে নিরাপত্তাকর্মীদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। তাঁদের গলায় ঝুলছে সচিত্র পরিচয়পত্র। সিসি ক্যামেরায় নজরদারি চালানোর বিজ্ঞপ্তিও টাঙানো জায়গায় জায়গায়। কিন্তু কোথাওই প্রবেশে আটকানো হল না। চিকিৎসক বা চিকিৎসাকর্মীর পোশাক তো দূর, সাদা পোশাকেই যেখানে খুশি পৌঁছে যাওয়া গেল হাসপাতালের ভিতরে। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, জানতেই চাওয়া হল না বহু জায়গায়। কোথাও আবার একটু ভেবে ভিতরের কোনও চেনা জায়গার নাম বলতে পারলেই ছাড়। এর পরে আর আটকানোর কেউ নেই। দেখা গেল, এ ভাবে চাইলেই যে কেউ পৌঁছে যেতে পারেন চিকিৎসক বা চিকিৎসাকর্মীদের জন্য বরাদ্দ ঘর বা পোশাক বদলের জায়গা পর্যন্তও!
প্রথমেই যাওয়া হয়েছিল ট্রমা কেয়ার বিল্ডিংয়ে, যেখানে নাবালিকা রোগিণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। ডিএল খান রোডের পাশের ট্রমা কেয়ার বিল্ডিংয়ের দরজায় তখন প্রবল ভিড়। পুলিশ গার্ডরেল বসিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া, কোনও পুলিশকর্মীর দেখা নেই। দরজায় দাঁড়ানো নিরাপত্তাকর্মী কাগজ দেখে দেখে রোগীদের ভিতরে ঢোকাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর সামনে দিয়ে প্রবেশ করলেও কোনও প্রশ্ন করা হল না। দু’পাশের পর পর ঘর পেরিয়ে ডান দিকের সিঁড়ি ধরে উঠে যাওয়া হয়েছিল উপরে। চারতলা পর্যন্ত প্রতিটি তলায় ঘুরলেও কেউই জানতে চাননি, কী প্রয়োজন। দোতলায় সেই পথেই ডান দিকে চোখে পড়ল একটি দরজায় ইংরেজিতে লেখা ‘মহিলা শৌচাগার’। তার নীচে আবার লেখা ‘শুধুমাত্র কর্মীদের জন্য’। বন্ধ কেন? প্রশ্ন করায় এক নিরাপত্তাকর্মী বললেন, ‘‘এখানেই তো খারাপ ঘটনাটা ঘটেছিল।’’ কিন্তু কেন জানতে চাওয়া হচ্ছে, জিজ্ঞাসা করলেন না তিনি। উল্টে কর্মীদের বরাদ্দ অন্য শৌচাগার দেখিয়ে দেওয়া হল ব্যবহারের জন্য। নামার মুখে গেটে বেসরকারি সংস্থার নিরাপত্তাকর্মী বিশ্বনাথ সাহাকে প্রশ্ন করা হল, তা হলে কিসের নিরাপত্তার কড়াকড়ি? তিনি বলেন, ‘‘কড়া ভাবেই দেখা হচ্ছে।’’
একই অবস্থা উডবার্ন ব্লকেও। সেখানেও গেটের মুখে চার নিরাপত্তাকর্মী উপস্থিত। দু’জন মোবাইল দেখতে ব্যস্ত। এক জন ঝিমোচ্ছেন। ভিতরে যেতে দেখে এক মহিলা নিরাপত্তাকর্মী শুধু জানতে চাইলেন, কোথায় যেতে চাই। দোতলায় যেতে চাই জানানোয় আর প্রশ্ন করা হয়নি। দোতলায় উঠে কোথায় যাওয়া হল, তা দেখার কেউ নেই। একই অবস্থা এসএসকেএম হাসপাতালের অন্য নানা ওয়ার্ড, বহির্বিভাগ বিল্ডিংয়ে। সেখানে আবার বিনা পরিচয়পত্রেই রোগী সামলাতে দেখা গেল অনেককে। তাঁদের গায়ে হাসপাতালের লোক পরিচয় বলতে ভরসা নীল পোশাক। যা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় বলে মন্তব্য করেছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী।
এসএসকেএমের এক শীর্ষ আধিকারিক যদিও বলেন, ‘‘বার বার বলার পরেও প্রয়োজনীয় কাগজ বা পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ ভিতরে ঢুকছেন কী ভাবে? এটা অবশ্যই দেখা হবে।’’ হাসপাতাল সূত্রের দাবি, পুলিশকে তৎপর হতে বলা হলেও মূল গেটে তাদের দেখা যায় না। কোণে বসে থাকে পুলিশ। বড় ঘটনা ঘটলেই আসে। বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স পার্কিংয়ে নজরদারিও থাকে না। কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ অফিসারের মন্তব্য, ‘‘আউটপোস্টগুলিকে সতর্ক হতে বলা হয়েছে। তার পরেও কী হচ্ছে, খোঁজ নিচ্ছি।’’