বাড়ির লোক পুড়িয়ে দিয়েছেন নথি, কমিশন গ্রাহ্য করছে না ট্রান্সজেন্ডার কার্ড! এসআইআরে আইনি পদক্ষেপ নিয়ে কী ভাবছেন রূপান্তরকামীরা?
আনন্দবাজার | ১৩ নভেম্বর ২০২৫
কারও নাম বদল হয়েছে। কেউ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করিয়েছেন। কেউ পরিবার থেকে বিতাড়িত। তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের রূপান্তরকামী, রূপান্তরিত এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। এই এসআইআর জমানায় নথি ছাড়া তাঁরা কী ভাবে নিজেদের পরিচয় প্রমাণ করবেন? নতুন লড়াই শুরু হয়েছে তাঁদের জীবনে।
অনেকেরই এসআইআর নিয়ে ধারণা এখনও স্বচ্ছ নয়। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকায় ১১টি নথির মধ্যে কোথাও ‘ট্রান্সজেন্ডার কার্ডে’র উল্লেখ নেই। নাম পরিবর্তনের পরে কিছু নথি বদল হলেও এখনও তাঁদের অনেক নথিই অপরিবর্তিত। কোন ঠিকানায় তাঁদের ‘এনুমারেশন ফর্ম’ আসবে? বিএলও-রা তাঁদের বিষয়ে কতটা সচেতন? বিভিন্ন উত্তরের খোঁজে কার্যত দিশাহারা রূপান্তরকামীরা।
ঘটনাচক্রে, সুন্দরবনে দুই কন্যার সমলিঙ্গের বিবাহের পর তাঁদের সংবর্ধনা দিয়েছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল। যার মাধ্যমে তারা ‘সামাজিক এবং রাজনৈতিক’ বার্তাও দিতে চেয়েছে। ঘটনাচক্রে, সেই সময়েই এ রাজ্যের রূপান্তরকামীরা তাঁদের ভোট-অস্তিত্ব নিয়ে চূড়ান্ত সমস্যায় পড়েছেন।
কলকাতা-ভিত্তিক এলজিবিটিকিউ সংগঠন ‘স্যাফো ফর ইকুয়ালিটি’-র ম্যানেজিং ট্রাস্টি কোয়েল ঘোষের কথায়, ‘‘এসআইআর নিয়ে স্বচ্ছ ধারণার অভাব আছে। পারিবারিক বা সামাজিক কারণে অনেকে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। পরিবারের সঙ্গেও তাঁদের যোগাযোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের কাছে নথি থাকা সম্ভব নয়। স্থায়ী ঠিকানা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারও জন্ম-শংসাপত্র থাকলেও বর্তমান নামের সঙ্গে সেই শংসাপত্রের নামের মিল নেই। এই অবস্থায় এনুমারেশন ফর্ম কোথায় আসবে?’’ বস্তুত, ফর্ম এলেও পরিবারের কী প্রতিক্রিয়া হবে, তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। দাবি উঠছে ট্রান্সকার্ডের তথ্য গ্রহণ করার। তবে কমিশনের নির্দেশিকায় এই নথির উল্লেখ নেই। সংস্কৃত কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সমতা বিশ্বাসের অভিযোগ, অনেকের বাড়ির সদস্যেরাই জন্ম-শংসাপত্র-সহ বিভিন্ন নথি পুড়িয়ে দিয়েছেন। নতুন নথির আবেদন-সহ বাকি কাজ সময়সাপেক্ষ। এ বিষয়ে কমিশন একটি নির্দেশিকা জারি করুক।
‘অ্যামিটি ট্রাস্ট’ সংগঠনের রূপান্তরিত মহিলা সমাজকর্মী অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, তাঁরা বার বার কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। একাধিক সংগঠনের তরফে চিঠি দেওয়া হয়েছে। জবাব মেলেনি। তাঁর কথায়, “এই সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে বসে আলোচনা করা দরকার। এসআইআর সংক্রান্ত সকলের সমস্যা এক নয়। সমস্যা আরও বহু ধরনের। জেলায় জেলায় নির্বাচন আধিকারিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।’’ অপর্ণার প্রশ্ন, “আমাদের ভোটে যাঁরা গদিতে বসেছেন, তাঁরাই আমাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেবেন?” রূপান্তরকামীদের জাতীয় কাউন্সিলের ‘নীরব’ অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অপর্ণা। সুরাহা খুঁজতে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
অপর্ণা উল্লেখ করেন, ২০২০ সালে কোভিডের সময় অনেকেরই রেশন কার্ড না থাকায় তাঁরা সরকার থেকে খাবারের কুপন সংগ্রহ করে রেশন নিয়েছিলেন। যেখানে বহু রূপান্তরকামীর ২০২০-’২১ সালে রেশন কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল না, সেখানে কী ভাবে ২০২৫ সালে তালিকায় তাঁদের নাম খুঁজছে সরকার? কী নথি দেখাতে পারেন তাঁরা? অপর্ণার উৎকণ্ঠা, “আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদের ত্যাগ করেছেন! এ বার কি সরকারও আমাদের ত্যাগ করে দেবে?”
২০১৪ সালে ‘ন্যাশনাল লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটি’ বনাম ‘ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া’ (নালসা) মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর অনেক রূপান্তরকামী ভোটাধিকার পেয়েছেন। তার আগে সিংহভাগ রূপান্তরকামী মানুষদের ভোটাধিকার ছিল না। ২০২০ সালে কার্যকর হয় ‘ট্রান্সজেন্ডার পার্সনস অ্যাক্ট’। সেই আইন অনুযায়ী জেলাশাসকের কাছে আবেদন করে নিজের নাম বদল করা যায়। এমনকি, ‘ট্রান্সজেন্ডার সার্টিফিকেট’ও পাওয়া যাবে। কিন্তু লিঙ্গ পরিবর্তনের আগের ও পরের নাম নিয়ে এবং ছবি নিয়ে সমস্যা রয়েই গিয়েছে।
সমাজকর্মী সোহম বসুর দাবি, সমগ্র এসআইআর প্রক্রিয়া কোথাও না কোথাও ২০১৪ সালের সুপ্রিম কোর্টের নালসা রায়কে লঘু করছে। তিনি জানান, অনেক রূপান্তরকামী মানুষ দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনাই করতে পারেননি। বিভিন্ন সমস্যার কারণে তাঁরা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তখন কোনও সরকার এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনি। তা হলে এখন কমিশন কী ভাবে ধরে নিচ্ছে যে, সকলের কাছে মাধ্যমিকের শংসাপত্র থাকবে? সকলের মতামত এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যের ভিত্তিতে আন্দোলনের কথা ভাবা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। কেউ জনস্বার্থ মামলা লড়লে তাঁদের জীবনের ঝুঁকিও থাকতে বলে আশঙ্কা এই সমাজকর্মীর।
চলচ্চিত্রনির্মাতা দেবলীনা মজুমদার (যিনি ‘গে ইন্ডিয়া ম্যাট্রিমনি’ ছবির পরিচালক) বলেন, “মোদী সরকার আসার পর থেকে আমরা শুধু কাগজই দেখিয়ে চলেছি। আর কত ভাবে আমরা কাগজ দেখাব জানি না।” তাঁরও আশঙ্কা, ‘‘আগে পরিবার তাড়িয়ে দিয়েছিল। এ বার কি দেশ থেকেও বিতাড়িত হতে হবে?’’
পশ্চিমবঙ্গের প্রথম রূপান্তরকামী মহিলা আইনজীবী মেঘ সায়ন্তন ঘোষের বক্তব্য, ‘পশ্চিমবঙ্গ ট্রান্সজেন্ডার উন্নয়ন বোর্ড’ রূপান্তরকামীদের জন্য কী করেছে সেটাই একটা বড় প্রশ্ন। সেখান থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তাঁর প্রশ্ন, নোডাল অফিসার বা বিএলও যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা আদৌ রূপান্তরকামী, রূপান্তরিতদের সমস্যার কথা ঠিকমতো জানেন? পাশাপাশি তিনি এ-ও জানান, যাঁদের নথির সমস্যা হচ্ছে, তাঁদের সঙ্গে বিএলওদের কথা বলা উচিত। নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ফর্ম পূরণ কী ভাবে করবেন, সেই সংক্রান্ত তথ্যও বিএলও-দেরই পরিষ্কার করে দেওয়া দরকার। তাতেও সুরাহা না হলে মামলার কথা ভাবা যাবে। সরকারকে এই সমস্যার গুরুত্ব বুঝে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
রূপান্তরিত মহিলা অধ্যক্ষ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্র রূপান্তরকামীদের জন্য কী কী করেছে? কিছুই তো করেনি। তা হলে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকায় রূপান্তরকামীদের নিয়ে আলাদা কিছু উল্লেখ থাকবে, সেটা আশা করা যায় কী ভাবে? মানবীর কথায়, “৩৫ বছর ধরে আমি এ রাজ্যে সরকারি চাকরি করছি। তার পরেও কি এসআইআর আমার কিছু করতে পারে?’’ তিনি জানাচ্ছেন, ব্যক্তিগত ভাবে এসআইআর নিয়ে তাঁর কোনও রকম সমস্যা হয়নি। এই ‘সমস্যা’ সাময়িক বলেই অভিমত তাঁর। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছেন, ভোট আবহেই কেন এসআইআর? এই প্রশ্ন যুক্তিযুক্ত।’’ মানবীর বক্তব্য, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকায় রূপান্তরকামী, রূপান্তরিত বা তৃতীয় লিঙ্গের কোনও উল্লেখ বা বিকল্প তথ্য নেই। সেটা কমিশনের ‘অযোগ্যতা’। বিএলও-দের ওয়াকিবহাল থাকার বার্তাও দিয়েছেন তিনি। তবে নাগরিক বলতে যা বোঝায় সেই জীবন রূপান্তরকামীদের নেই বলেই দাবি অধ্যক্ষার। তাঁর কথায়, “পথকুকুর ও আমাদের কোনও পার্থক্য নেই।”
আইনি পদক্ষেপ নিয়ে ক্যুইর নারীবাদী এক সমাজকর্মী (নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, সকলেই আতঙ্কিত। চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে জনস্বার্থ মামলা করতেও ভয় পাচ্ছেন অনেকে। তাঁর কথায়, একটা মামলা করলেই তো হল না। সেটা করার আগে সঠিক তথ্য লাগবে। এই রাজ্যে মোট কত রূপান্তরকামী, রূপান্তরিত এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আছেন, তার কোনও হিসাব নেই। অনেকে ভিন্রাজ্যে আছেন। বহু রূপান্তরকামী মানুষ আছেন যাঁরা যৌনকর্মী বা বাস্তুচ্যুত। কারও আবার স্থায়ী ঠিকানাই নেই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভয় পেয়ে অনেকেই পিছু হটতে বাধ্য হন।
বেঙ্গল ট্রান্স অ্যান্ড ক্যুইর ফাউন্ডেশন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা কৌণিশ দে সরকারের দাবি, এই ধরনের মানুষদের সব সময়েই নথি নিয়ে সমস্যা থাকে। তাঁর আরও দাবি, পরিচয় সঙ্কটের পাশাপাশি নতুন করে যুক্ত হল এসআইআর। ভয় পেয়ে কেউ যাতে কোনও ভুল সিদ্ধান্ত না নেন, সেদিকে নজর রাখা উচিত বলে মনে করছেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে অনেক সংগঠন বিভিন্ন রকমের কর্মসূচি ও পরিকল্পনা নিয়েছে বলে জানান তিনি।
আপাতত কমিশনের উত্তরের আশায় রূপান্তরকামীরা। তাঁদের দাবি, বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কমিশন অন্তত বলে দিক, কী ভাবে তাঁরা ‘এনুমারেশন ফর্ম’ পূরণ করবেন। কোন কোন নথি দেখালে এই সমস্যা মিটতে পারে, তা-ও কমিশনের তরফে জানিয়ে দেওয়া উচিত। দাবি উঠছে ট্রান্স কার্ড নিয়ে ‘অস্বচ্ছতা’ দূর করারও।