লণ্ঠনের ‘আলো’ প্রত্যাখ্যান করে বিহার বোঝালো, অস্তাচলে নয়, নীতীশ মধ্যগগনেই
প্রতিদিন | ১৪ নভেম্বর ২০২৫
সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: প্রশান্ত কিশোর দাবি করেছিলেন, “বিহারে পঁচিশের বেশি আসন পাবে না জেডিইউ। নীতীশ কুমার আর মুখ্যমন্ত্রী হবেন না।” তেজস্বী যাদব বলেছিলেন, “নীতীশবাবু অসুস্থ। তাঁকে চালনা করছেন বিজেপির উচ্চবর্ণের নেতারা।” এমনকী ভোটের পর তাঁর দল ভেঙে যাবে বলেও তোপ কটাক্ষ করছিলেন কেউ কেউ। নীতীশ ফিনিশ। কিন্তু বিহার বিধানসভা নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফলের ইঙ্গিত প্রকাশ্যে আসতেই দেখা গেল নীতীশ ফিনিশ নন, বরং ফিনিক্স। তাঁর দল বিহারে শুধু ফিরছেই না রীতিমতো হইহই করে ফিরছে। সব ঠিক থাকলে জোটসঙ্গী বিজেপিকেও ছাপিয়ে যাবেন বিহারের ৯ বারের মুখ্যমন্ত্রী।
২০ বছর ধরে কুরসিতে থাকার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, প্রকাশ্যে একের পর এক অসংলগ্ন আচরণের ভিডিও ভাইরাল হওয়া। বিধানসভায় দাঁড়িয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করা ভোটের পাঁচ-ছ’মাস আগেও নীতীশ কুমারকে নিয়ে বিহারে বাজি ধরবেন হেন কেউ ছিলেন না। কিন্তু শেষ ছ’মাসে কী এমন করলেন বিহারের সুশাসনবাবু, যে সব সমীকরণ বদলে গেল? ফ্যাক্টর একাধিক।
মহিলা ভোট: জাতপাত ও ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতিতে ক্লিষ্ট বিহারে নীতীশ কুমার নিজস্ব একটি ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করেছেন। সেটা হল মহিলা ভোট। সেই ২০০০ সালে ক্ষমতায় এসেই মহিলা ভোটারদের মন পেতে মন দেন নীতীশ। প্রথম কাজ রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ঠিক করা। যে বিহারে একটা সময় মেয়েদের সন্ধের পর বাড়ির বাইরে বেরনো আতঙ্কের কারণ ছিল, সেখানেই তিনি ধীরে ধীরে দুষ্কৃতীরাজ দমন করার চেষ্টা করলেন। অনেকাংশে সফলও হলেন। সেই সঙ্গে শুরু হল মহিলা শিক্ষায় জোর, মেয়েদের প্রগতির জন্য সাইকেল দেওয়া। টুকটাক সরকারি প্রকল্পে মহিলাদের সাহায্য করা। স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলিকে উৎসাহিত করা, ‘জীবিকা দিদি’ তৈরি করা।
সুরাবন্দি: বিহারের মহিলাদের জীবন অনেকাংশে বদলে দিয়েছে নীতীশের সুরাবন্দি। এ কথা ঠিক, এখনও গোটা বিহারেই মদ পাওয়া যায়। কিন্তু খুল্লমখুল্লা মদ্যপান আর লুকিয়েচুরিয়ে মদ্যপানের বিস্তর ফারাক। এই সুরাবন্দির ফলে গার্হস্থ্য হিংসা, সংসারে অশান্তি কমেছে। কমেছে অনটন। তবে এই সুরাবন্দি পুরনো ইস্যু। তাতে এবার নতুন করে সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল না নীতীশের। এখানেই আসরে চলে এলেন প্রশান্ত কিশোর। তিনি ঘোষণা করলেন বিহারে ক্ষমতায় এলে মদ ফের চালু হবে। তেজস্বী যাদব আবার বলে গেলেন, ক্ষমতায় এলে তাড়ি বৈধ করা হবে। ভয় পেলেন বিহারের মহিলারা। আরও একজোট হল নীতীশের ভোটব্যাঙ্ক।
১০ হাজারি ভোট: ভোটের আগে নীতীশের মাস্টারস্ট্রোক মহিলাদের অ্যাকাউন্টে সোজা ১০ হাজার টাকা করে পাঠানো। যে মহিলা ভোটব্যাঙ্ককে তিনি দীর্ঘদিন ধরে লালন-পালন করে এসেছিলেন, সেই মহিলারা এবার প্রতিদান দিল। ভোটের হারে দেখা গেল পুরুষদের থেকে অনেক এগিয়ে মহিলা ভোটার। শুধু তাই নয়, মোট ভোটের সংখ্যাতেও এই প্রথমবার পুরুষদের ছাপিয়ে গেল প্রমিলাবাহিনী। ধর্ম, জাত, সামাজিক সমীকরণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে নীতীশকে সমর্থন করলেন মহিলারা।
যুবসমাজ: এ কথা ঠিক যুব সমাজের একটা বড় অংশ রোজগার না পেয়ে নীতীশের উপর খাপ্পা। আবার এটাও সত্যি সেই খাপ্পা ভোটারদের ফিরে পেতে শেষবেলায় মাসে হাজার টাকা, দক্ষতা উন্নয়নের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের মতো প্রকল্প শেষ ছ’মাসে ঘোষণা করেছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। ফলে যুবসমাজের ভোট যতটা ছিটকে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল, ততটা যায়নি।
সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা না করা: বিজেপি বারবার বলেছে, বিহারে তাঁরা ভোটে লড়বেন নীতীশ কুমারের নেতৃত্বে। কিন্তু ভোটের পর কি তাঁকেই মুখ্যমন্ত্রী করা হবে? একবারও বলেননি অমিত শাহরা। উলটে তাঁরা বলে গিয়েছেন, ভোটের পর বিধায়করা ঠিক করবেন কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন। ফলে নীতীশের যারা কোর ভোটার, তাঁদের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল জেডিইউয়ের থেকে বিজেপি বেশি আসন পেয়ে গেলে হয়তো বিজেপি নিজেদের মুখ্যমন্ত্রী করতে চাইবে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল মহারাষ্ট্রে। সেই আশঙ্কা থেকেই এককাট্টা হয়ে ভোট দিয়েছেন নীতীশের ভোটাররা। এদের একটা বড় অংশ ২০২০ সালে হয় ভোট দেয়নি, নয়তো চিরাগ পাসওয়ানকে ভোট দিয়েছিল।
জাতপাতের সমীকরণ: উপরের এতকিছু বলার পরও জাতপাতকে উপেক্ষা করা যায় না। এবার চিরাগ পাসওয়ান এনডিএ-তে যোগ দেওয়ায় দলিত, মহাদলিত, ওবিসি, ইবিসি এবং স্ববর্ণদের ভোট দিয়ে দুর্দান্ত জাত সমীকরণ তৈরি হয়েছিল। যার পালটা দেওয়া সম্ভব হয়নি মহাজোটের পক্ষে।
ব্যক্তিগত ক্যারিশমা: ২০ বছর ধরে সুশাসনবাবুর যে ভাবমূর্তি নীতীশ তৈরি করেছেন সেটা এবার কাজে লাগল। আসলে নীতীশ নিজে এবারের ভোটে দুর্দান্ত প্রচার করেছেন। কোনও বিতর্কে জড়াননি, নীরবে প্রচার করে গিয়েছেন। বিজেপির কাছে মাথা নোয়াননি। জুনিয়র পার্টনার হতে চাননি। নিজের পছন্দের প্রার্থী হওয়া নিয়ে আপস করেননি। নীরবে সভা করে গিয়েছেন। তাছাড়া এটাই নীতীশের শেষ ভোট সেই আবেগও কাজে লেগেছে।
আসলে নীতীশকে যারা চেনেন তাঁরা জানেন, প্রশাসন-দল সবকিছু যে নৈপুণ্যের সঙ্গে তিনি পরিচালনা করেন, তাতে তাঁকে সহজে খরচের খাতায় ফেলে দেওয়াটা বোকামি। তাছাড়া এতদিনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকেও অবজ্ঞা করা যায় না। অতএব, বিহারে ‘পঁচিশ সে তিরিশ, ফির সে নীতীশ। ‘ ও এদিন ভোটের ফলাফল চূড়ান্ত হওয়ার আগেই পাটনার জেডিইউ দপ্তরের সামনে পোস্টার দেখা গিয়েছে, ‘টাইগার আভি জিন্দা হ্যায়।’