• জঙ্গলরাজের আতঙ্ক নাকি সুশাসন বাণ, কোন কারণে বিহারে ধূলিসাৎ কংগ্রেস-আরজেডি মহাজোট?
    প্রতিদিন | ১৪ নভেম্বর ২০২৫
  • সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ‘যব তক রহেগা সমোসে মে আলু, বিহার মে রহেগা লালু।’ অরণ্যের প্রাচীন এই প্রবাদ হয়তো এবার ‘জঙ্গলে’ ফেলার সময় এসে গিয়েছে। কারণ বিহারবাসী এখনও লালুর জঙ্গলরাজের আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। অন্তত ২০২৫ সালের বিহার ভোটের ফলাফলের (Bihar Election Result) ট্রেন্ড সে কথাই বলছে। এই প্রতিবেদন যখন লেখা হচ্ছে, তখনও পর্যন্ত বিহারের ফলাফল বলছে, নীতীশ কুমারের নেতৃত্বাধীন এনডিএ দু’শোর কাছাকাছি আসন পেতে পারে। আর তেজস্বী যাদবের নেতৃত্বাধীন মহাগটবন্ধন ৫০ আসন পাওয়া নিয়েও সংশয়ে। আরজেডি, বাম, কংগ্রেস সবারই এক হাল। বিশেষ দুরবস্থা কংগ্রেসের। কেন এই ফল?

    জঙ্গলরাজের আতঙ্ক: বিহারে শেষ ২০ বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রীর কুরসিতে নীতীশ কুমার। সেই হিসাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কাজ করার কথা নীতীশের বিপক্ষে। কিন্তু বিহারবাসীর একটা বড় অংশ তারও আগের ১৫ বছরের লালু-রাবড়ির শাসনকাল নিয়ে এতটাই ত্রস্ত যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা যেন তেজস্বী যাদবের বিরুদ্ধেই কাজ করল। আর জঙ্গলরাজের সেই স্মৃতি উসকে দিয়েছেন আরজেডি নেতাদেরই একাংশ। তেজস্বী যাদব যখন কোথাও কোনও জনসভায় যান, তিনি যান গোটা পঞ্চাশেক গাড়ির কনভয় নিয়ে। সেই কনভয়ে শুধু উগ্র, যুবকদের (পড়ুন গুন্ডাদের) ভিড়। এমনও হয়েছে, তেজস্বী মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন এই আশায় যাদব সম্প্রদায়ের যুবকরা রীতিমতো দাদাগিরি শুরু করেছেন, কেউ অস্ত্র নিয়েও ঘুরেছেন। সব মিলিয়ে আম ভোটারের মনে হয়েছে, ক্ষমতায় না ফিরলেই এই, ফিরল না জানি কী হবে?

    তেজস্বীকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা: তেজস্বী যাদব। তরুণ, পরিশ্রমী, জনপ্রিয়তা আছে, সব ঠিক। কিন্তু নীতীশ কুমারের মতো ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো জায়গা থেকে এখনও তিনি শত যোজন দূরে। ভুলে গেলে চলবে না তিনি পরিবারতন্ত্রের ফসল। নবম শ্রেণি পাশ পয়ত্রিশের যুবক, ২০ বছরের মুখ্যমন্ত্রীর সুসাশনবাবুকে হারিয়ে দেবেন, এটা ভাবাটাই বোধ হয় ধৃষ্টতা। তাছাড়া, লালুপ্রসাদ যাদবের ছেলে বিহার মসনদে বসলে জঙ্গলরাজ ফিরবে না তো? এই আতঙ্ক এখনও তাড়া করছে বিহারবাসীকে। ফলে তেজস্বীকে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ হিসাবে ঘোষণা করা বড় ভুল মহাজোটের।

    অতিরিক্ত যাদব-মুসলিম নির্ভরতা: ১৪ শতাংশ যাদব, ১৯ শতাংশ মুসলিম, ৯ শতাংশ নিষাদ। এই সহজ সমীকরণে বিহার জয়ের ছক কষেছিল মহাজোট। এ কথা ঠিক যে বিহারের রাজনীতিতে এখনও জাতপাত বড় ব্যাপার। কিন্তু সেটাই কাল হল। বিহারবাসীর একটা বড় অংশ সরল জাতপাতের সমীকরণ থেকে বেরিয়ে এসেছেন। যুব সমাজ এবং মহিলাদের নিয়ে নীতীশ যে নতুন এম-ওয়াই সমীকরণ তৈরি করে ফেলেছেন, সেটা ভাঙার কোনও উপযোগী উপায় খুঁজে পায়নি মহাজোট।

    সমন্বয়ের অভাব: মহাগটনন্ধনের শুরুটা ভালো হয়েছিল। রাহুল গান্ধীর ভোটার অধিকার যাত্রায় একসঙ্গে প্রচার শুরু করেছিলেন রাহুল-তেজস্বীরা। কিন্তু যাত্রা শেষ হতেই ছন্দপতন। আসন সমঝোতা নিয়ে রীতিমতো খেয়োখেয়ি করল বিরোধী শিবির। এমন পরিস্থিতি দাঁড়াল যে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন পেরিয়ে গেলেও আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হল না। তেজস্বীকে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ হিসাবে ঘোষণা করা হল একেবারে শেষবেলায়। যে চক্করে মাসখানেক প্রচারে সেভাবে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা, এমনকী আরজেডির শীর্ষ নেতাদেরও প্রচারে দেখা গেল না। ততদিনে ঘর গুছিয়ে ফেলেছে এনডিএ। যার সুফল মিলল ভোটের ফলে।

    উপমুখ্যমন্ত্রীর মুখ ঘোষণা: নিষাদ ও মাল্লা ভোটের আশায় ভিআইপি নেতা মুকেশ সাহানিকে উপমুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে মহাজোট। যা ব্যাকফায়ার করেছে। এক তো মাল্লা-নিষাদ ভোটে সেভাবে টানতে পারেননি মুকেশ। দুই, মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষোভ। ১৯ শতাংশ মুসলিম ভোট, অথচ মহাজোট কেন মুসলিম কাউকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করল না, এই নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয় সংখ্যালঘু মনে। যার ফায়দা তুলে নেন আসাদউদ্দিন ওয়েইসি। সীমাঞ্চলে তাই ওয়েইসি সমূহ ক্ষতি করেছেন কংগ্রেস-আরজেডির। ভোট কাটাকাটির ফায়দা পেল বিজেপি-জেডিইউ। গোটা সীমাঞ্চলে কার্যত ধুয়েমুছে সাফ মহাজোট। অথচ, এই এলাকাতেই সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়ার কথা তাঁদের। 

    ভুল প্রচার: বিহারে ভোটের মুখে রাহুল গান্ধী তথা কংগ্রেস প্রচারের মূল ইস্যু হিসাবে তুলে এনেছিলেন SIR-কে, ভোটচুরিকে। যা কোনওভাবেই বিহারের স্থানীয় ইস্যু নয়। তাছাড়া SIR শেষ হয়ে যাওয়ার পর বেশি বৈধ ভোটারের নাম বাদ না যাওয়ায়, সেই ইস্যুও ধোপে টেকেনি। মাঝখান থেকে মূল যে ইস্যু সেই বেকারত্ব, দলিত নির্যাতন, দুর্নীতি, সেসব পিছনে পড়ে গিয়েছে। তাছাড়া শেষবেলায় এসে তেজস্বী যে সব পরিবারকে চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন, সেটাও বিশেষ বিশ্বাসযোগ্য হয়নি আমজনতার।

    ফলে একটা সময় সম্ভাবনা দেখালেও মহাজোট শেষ পর্যন্ত মুখ থুবড়ে পড়ল। এর পর মহাজোটের লড়াই একটাই, নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখা।
  • Link to this news (প্রতিদিন)