মাটির গান, জলের সুর। আলোর নাম আব্বাসউদ্দীন আহমদ। যে আলোয় ধুয়ে যায় বাংলাদেশে মুসলমান আর হিন্দু শিল্পীর এক মঞ্চে গান গাওয়ার বাধা।
আনন্দবাজার | ১৪ নভেম্বর ২০২৫
২০১৩-য় মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা ছবি শব্দ, তার মূল চরিত্র তারক শব্দ থেকে আসা আলোর সাগরে ডুবে গিয়েছিল, সিনেমার জন্য শব্দের খোঁজে। আর এক বালক আব্বাস জন্মভূমি বলরামপুরের কালজানি নদীতে নিস্তব্ধ দুপুরে পা ডুবিয়ে বসে বর্ষার ব্যাঙের ডাক শুনতে শুনতে ভাবত, ‘হলুদ গায়ে মেখে যেন হলদে পরীর বাচ্চারা আনন্দে গান গেয়ে চলেছে’। সারা দিন খেটে হয়রান মায়ের বুকে মাথা দিয়ে সে পূর্ণিমার রাতে ঝিঁঝির ডাক শুনত, চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া রাতে গান হয়ে যেত সে ডাক। ভোরে নানি যখন ইঁদারায় জল তুলতেন, চুপটি করে পিছনে এসে দাঁড়িয়ে নানিকে চমকে দিতে যেই না সাড়া দিত সে, প্রতিধ্বনি উঠত ইঁদারায়, আর বালকমন নিজেই সে শব্দে উঠত চমকে। বাকি জীবন সেই বালকও ডুবে গিয়েছিল সুরের আলোর সাগরে।
সেই আলোর নাম আব্বাসউদ্দীন আহমদ। যে আলোয় ধুয়ে যায় বাংলাদেশে মুসলমান আর হিন্দু শিল্পীর এক মঞ্চে গান গাওয়ার বাধা। শুধু এক মঞ্চ নয়, একই গানে গীতিকার ও সুরকার যে ভিন্নধর্মের হতে পারেন, সেই আলোকিত বার্তাও এল তাঁরই হাত ধরে। এর আগে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে যখন ইসলামি গানের রেকর্ড বেরোচ্ছে, তখন চাহিদার সঙ্গে জোগানকে মেলাতে, মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্যতার প্রয়োজনে চিত্ত রায় নাম নিলেন দেলওয়ার হোসেন, হিন্দু শ্রোতারা যাতে রেগে রেকর্ড কেনা বন্ধ না করে দেয়, তাই মহম্মদ কাশেম মল্লিক নাম নিলেন কে মল্লিক। আশ্চর্যময়ীর নাম হল সাকিনা বেগম। ধর্ম নিয়ে এই অর্থহীন ছুতমার্গ সুরের বন্যায় ভেসে গেল, লুপ্ত হল শিল্পের অবলীলা উপেক্ষায়, যখন কাজী নজরুল ইসলাম শুরু করলেন ইসলামি গান। তাতে সুর দিলেন কমল দাশগুপ্ত বা চিত্ত রায়, তাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিলেন কে মল্লিক। আর এই গোটা বিষয়টার কান্ডারি হয়ে থাকলেন আব্বাসউদ্দীন।
শুধু শিল্পীদের ধর্মকে নিয়েই বিপ্লব করেননি আব্বাসউদ্দীন। শিল্পের ভাষাও ছিল তাঁর বেদনার জায়গা। কোচবিহারের প্রচলিত রাজবংশী ভাষায় গান গাইতে গেলে রেকর্ড কোম্পানি বাদ সাধে, কিন্তু নিজের ভাষা কী করে অচেনা পোশাকে মুড়বেন? এ ভাষায় যে লুকোনো আছে অরণ্যের সঙ্কুলতাকে জয়ের অহঙ্কার, সব অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা মোকাবিলার সাহস। রেকর্ড সংস্থার সঙ্গে রীতিমতো ঝগড়া করে সেই ভাষাতেই গাইলেন তিনি।
এক অদ্ভুত সময়ে তাঁর জন্ম। বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন পর্বে প্রতিবাদের মশাল ছড়িয়ে পড়ছে কলকাতা ময়মনসিংহ বরিশালে জনজাগরণের গান নিয়ে, তখন তাঁর বাল্যকাল। তারুণ্যে পৌঁছে নিজেই সেই মশালের আলো জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব নিলেন। বলরামপুর ছেড়ে প্রথমে কোচবিহার, পরে তুফানগঞ্জ এলেন। চোখের সামনে দেখলেন মুকুন্দ দাসের নির্ভয় স্বদেশি যাত্রা, গ্রেফতারি পরোয়ানা, কারাদণ্ড। আগুন জ্বলবে কিছু দিন পর, সশস্ত্র বিপ্লবের দিন আসবে, ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের ধারা যাবে পাল্টে— সব দেখছে এক যুবক, যে তখন কলকাতায় বাসা নিয়েছে গ্রামোফোন কোম্পানিতে গান রেকর্ড করবে বলে। আমার শিল্পী জীবনের কথা-য় লিখেছেন, “বৃহত্তর জীবনের স্বাদ এল। সারা বাংলার গ্রামে গ্রামে শহরে শহরে ট্যুর করবার অবাধ স্বাধীনতা। গেয়ে গেয়ে ফিরতে লাগলাম বাংলার শত সমস্যার সমাধানের বাণী।”
দেশের কাছে, মানুষের কাছে এক শিল্পীর যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে দাঁড়ানোর কথা, আব্বাসউদ্দীনেরও সেই একই পথ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নবান্ন, ছেঁড়া তার, দুখীর ইমান যে ভাবে রক্তে দোলা দিয়েছে, তেমন করেই রক্ত ছলকেছে আব্বাসউদ্দীনের সুরেও: ‘দুধের শিশু মায়ের কোলে কাঁদছে অন্ন অন্ন বোলে/...সে যে কখন যেন পড়বে ঢলে রে ত্যজি সবের যন্ত্রণা।’ এ গানের গীতিকার জসীমউদ্দীন, ছায়া হয়ে থেকে আব্বাসউদ্দীনকে জীবনের পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন যিনি। সু্র প্রক্ষেপণের যে জাদুদণ্ডে আব্বাসউদ্দীনের গান ছবির মতো আঁকা হত করিমুদ্দি, সর্বেশ্বর দাস, ধলাই মিয়াঁদের চোখে, তা তিনি শিখেছেন জসীমউদ্দীনের হাত ধরে।
সঙ্গীতকে তিনি অস্ত্র করেছিলেন সর্বার্থে। ক্যাসেট বা রেকর্ড করতেন ঠিকই, কিন্তু এ কথা মনে রেখেছিলেন সর্বদা যে, একেবারে খোলা মাঠে, জনসাধারণের মাঝে দাঁড়িয়ে যা বলার বলতে হবে গান গেয়ে। সাধারণ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে, মাটি আর জলের গন্ধে ভরপুর ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুরশিদা, বিচ্ছেদী, ক্ষীরোল গাওয়াকেই ঠিক পথ মনে হয়েছিল তাঁর। প্রত্যেক লোকসঙ্গীতশিল্পী যাতে তাঁদের গলায় খাঁটি মেঠো সুর বাঁচিয়ে রাখতে পারেন, সেই চেষ্টা করে গেছেন তিনি— সে গানে ফুটবে গ্রামীণ জীবন-ভাবনা, বাঁধা হবে প্রাণের টানে। এও এক বিপ্লব, সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার। সেই বিপ্লবকে আজীবন ভালবেসেছেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ। গত ২৭ অক্টোবর চলে গেল তাঁর জন্মদিন— জন্মের ১২৫ বছরের সূচনালগ্নে এই বৈপ্লবিক মানুষটির সঙ্গীতদর্শন যেন মনে রাখি আমরা।