‘আমার কলকাতা কানেকশন গভীর’, টলিপাড়ায় পা রেখে আবেগে ভাসলেন অভিনেতা সঞ্জয় মিশ্র
প্রতিদিন | ১৫ নভেম্বর ২০২৫
দক্ষিণ কলকাতার একটি বাড়িতে পৃথা চক্রবর্তীর ছবি ‘ফেরা‘ -র শুটিং চলছিল। ‘আঁখো দেখি’, ‘মাসান’, ‘কাম্য়াব’, ‘বধ’ খ্যাত অভিনেতা সঞ্জয় মিশ্রর প্রথম বাংলা ছবি। সহ অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তী তাঁর ছেলের চরিত্রে, সোহিনী সরকার বাড়িওয়ালি। দুপুরবেলায় লাঞ্চ ব্রেকে কথা বলতে রাজি হলেন। ঘি ভাত, লেবু আর দই ছাড়া কিছু খাবেন না। ‘কাজের মধ্যে আছি, বেশি খিদে নেই’, বলে হাসলেন অভিনেতা। সাক্ষাৎকারে বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
এই তো কিছুদিন আগে বড় পর্দায় ‘দিল সে’ দেখতে গিয়ে আপনাকে দেখলাম, কত কম বয়স তখন, কেরিয়ারের শুরুর দিকে, ছোট্ট চরিত্র…
হ্যাঁ, মনি রত্নমের জন্যই ছবিটা করেছিলাম। কিছু পরিচালক থাকেন যাদের না করা যায় না, যত ছোটই চরিত্র হোক না কেন !। মনি রত্নম যেমন। আপনি তবলা বাদক, যদি রবিসংকরের সঙ্গে না বাজান তাহলে আর কি হল ! যদি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ না করেন ! তেমন আর কি ! আমাকে একজন বলল টেরোরিস্টের চরিত্রের জন্য লাগবে। মুম্বইয়ের হোটেলে দেখা করলাম। পাশে একজন বসে ছিলেন। মণি স্যার বললেন একে চেনো ? আমি ভাবলাম হবে কোনও অ্যাসিস্টেন্ট! তিনি রামগোপাল বর্মা ! চিনতে না পেরে লজ্জায় চলে যাচ্ছি, রামগোপাল বললেন, আমি একটা ছবি করছি ‘সত্য’, তুমি করবে? কী সব দিন ছিল। ‘দিল সে’-র স্মৃতিও মনে পড়ে। অসম্ভব ভালো মিউজিক। ‘ছাইয়া ছাইয়া’ তো একটা অন্য দিক খুলে দিল। আমার গান নয় কিন্তু ওই গানে আমিও ঢুকে পড়েছিলাম। ট্রেনের একেবারে সামনে দিকে বসেছিলাম। গাছের বড় ডালপালা এলে আগে থেকে সাবধান করে দিচ্ছিলাম।
সেই শাহরুখের প্রযোজনাতেই কাময়াব। যেভাবে ছোট, এক্ট্রা রোলে অভিনয় করে আপনার উত্থান, তেমন অভিনেতাকে নিয়েই তো এই ছবি !
শাহরুখের ভালো স্ক্রিপ্ট চেনার চোখ আছে। এই ছবিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আমার কেরিয়ারে। মনে হয় যেন নিজের কেরিয়ারের গল্পে নিজেই অভিনয় করেছি। আমি বেশ কিছু ভালো পরিচালক আর প্রযোজক পেয়েছি যারা আমাকে অন্য ধরনের কাজের সুযোগ দিয়েছেন। সব সিনেমা তো আর বিজনেস দিয়ে ভাবলে হয় না, সিনেমার জন্য প্যাশন চাই।
আপনি তো কেরিয়ারের শুরুতে আর্ট ডিরেক্টরেরও কাজ করেছেন!
হ্যাঁ, করেছি। সিনেমা ভালবাসি, সেই সংক্রান্ত যা বলবে করে দেব। ক্যামেরাম্যানও হয়ে যেতে পারতাম। মনে আছে একেবারে শুরুর দিকের কথা। তিগমাংশু ধুলিয়া এনএসডি-তে আমার ব্যাচমেট ছিল। ও একটা টিভি সিরিজ করছিল ‘হম বোম্বাই নেহি জায়েঙ্গে‘। ইরফান ভাই থে উসমে। এনএসডি-র সব অভিনেতারা। তিগমাংশু বলল, মিশ্র তু কুছ কর দে! আমিও আর্ট ডিরেক্টর হয়ে গেলাম। তখন আর্ট ডিরেক্টরকে, সেটিং বলা হত! জীবনে অনেক অভিনয় করে নিয়েছি। প্রথমে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। তারপর সমাজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়। তারপর বোধহয় নিজের জন্য কাজ করতে হয়। শুধুই কমেডি অভিনেতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকতে চাই না। কাদের খানকে মনে আছে! বড় অভিনেতা কিন্তু শুধুই কমেডিতে আটকে দেওয়া হল। এখানে কমেডি মানে তো শুধু বকবক! যখন আঁখো দেখি অফার করা হয়েছিল, অবাক হয়েছিলাম। তারপর সিনেমা স্ক্রিনিং-এর পর নানা মানুষ এসে কথা বলছে। বলছে, আমার চাচাজি আপনার মত ছিলেন, একটু জড়িয়ে ধরব! ছবিটা আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল। আঁখো দেখির মত ছবি হল টেস্ট ম্যাচ, আর মেনস্ট্রিম কমেডি হল টি-টোইয়েনটি!
কীভাবে প্রভাবিত করেছিল ?
সেটা বুঝতে পেরেছিলাম আমার দাদি অসুস্থ হওয়ার সময়। তখন কারও সঙ্গে কথা বলছি না। হাসপাতালে একজন প্রায় মৃত্যুপথযাত্রীকে দেখলে আমরা বাইরে থেকে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি, সে কি ভাবছে বোঝার চেষ্টা করি না। দাদি এক সুগন্ধি তেল মাখতেন। সেটা খুঁজে এনে একদিন লাগিয়ে দিলাম। দাদির ফোকলা দাঁতে হাসি ফুটল। জীবনকে দেখার চোখ বদলে যায়।
জীবনের সঙ্গে কী সেটিং আপনার ?
ব্যস, বেঁচে থাকতে চাই। এই কয়েকদিন এত সুন্দর কাটালাম। কলকাতায় এসে খুব খুশি হয়েছি। আমার জন্ম পাটনাতে হলেও, বাংলার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। বাবার বদলির চাকরি ছিল। আমি তখন খুব ছোট। এসেছিলাম কলকাতায়। তারপর বেনারস বদলি হয়ে গেল। আমার কলকাতা কানেকশন আছে। বাড়িতে ফোন করেছিলাম ধর্মতলা থেকে, মা শুনেই বলল এখানে কেসি দাসের মিষ্টির দোকান আছে, বলে দিল কি মিষ্টি খেতে হবে। ঝর্ণা ঘি দিয়ে গোবিন্দভোগ, বড়ি, চচ্চরি, কচু বাটা — এসব প্রিয় খাবার। ধর্মতলায় এসে প্রেস ব্যুরোর অফিসের সিড়িতে বসে বিড়ি খেলাম, বাবা নিশ্চয়ই এখানে বসে সেটাই করেছিলেন! এখান থেকে বাবা পাটনা গেলে বাবা কেসি দাস থেকে মিষ্টি নিয়ে যেতেন! বাবা সরোদ বাজাতেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাবার গুরু ছিলেন। আলাউদ্দিন খাঁ এর শিষ্য জ্যোতিন ভট্টাচার্য আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন। যেদিন বাবা চলে গেলেন, বুঝলাম এর চেয়ে বড় সারপ্রাইজ জীবনে আর নেই!
আপনি জানেন, এর মধ্যে কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ঋত্বিক ঘটকের সব ছবি দেখানো হল!
তাই নাকি! আমার খুব ইচ্ছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ বড় পর্দায় দেখার। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ আর ‘জলসাঘর’-এর ভিনাইল রেকর্ড যদি পাওয়া যেত! এই ছবির সংগীত! ভাবা যায় না! এখানে পাওয়া যাবে?
সেটা বলা মুশকিল! আচ্ছা বাংলা ছবি করতে রাজি হলেন কেন ?
পরিচালক পৃথা চক্রবর্তীর মূল্যবোধ আমার সঙ্গে মেলে। বহত সমঝদার হ্যায় পৃথা। প্রথম যেদিন নার্ভাস হয়ে কাঁপতে কাঁপতে এল অফিসে দেখা করতে, বললাম আগে বাড়ি এস, মাছ ভাত খাও তারপর কথা হবে। পান্নালালের চরিত্রের সঙ্গে রিলেট করতে পারি। আর আমি ভয়ে ভয়ে কলকাতা এসেছিলাম, এখানে অভিনয়ের ধারা নিয়ে আমার ভুল ধারণা ছিল। কিন্তু সোহিনী আর ঋত্বিককে দেখে বুখলাম ওরাও আমার স্কুল অফ অ্যাকটিং-এই বিশ্বাসী। আর ঋত্বিক তো দারুণ অ্যাক্টর, বলা ভালো রিয়াক্টর!
যদি ফিরতে পারতেন?
আমার শৈশবে ফিরতাম। যেখানে এই কলকাতার মত খড়খড়ি দেওয়া জানলা আছে, বেনারস, ছোটবেলা, পাপা কা ঘর! মুম্বইয়ের কংক্রিটের বিল্ডিং থেকে ডেডবডি বেরনোতে আমি উৎসাহী নই। লোনাভলার গ্রামে আমার একটা ফার্মহাউজ আছে, সেখানে এবার নবরাত্রির সময় গিয়েছিলাম। প্রথম দিন ভোরবেলায় মহালয়া চালিয়ে দিয়েছিলাম। আগে আমাদের মেরে ধরে ঘুম থেকে তুলে দিত বড়রা মহালয়া শোনার জন্য। এখন আর কেউ এসব শোনে না! এই কলকাতা থেকে চলে যাব, অন্য কাজ শুরু করব, এই ছবির পান্নালাল মরে যাবে।
সম্প্রতি একটি ছবির প্রচারে মহিমা চৌধুরীর সঙ্গে আপনার ছবি শোরগোল ফেলে দিল!
আর বলবেন না। আজকাল প্রচারের নানা ঢং! আমার মায়ের কাছে কত ফোন এসেছে ভাবতে পারবেন না। তারা ফোন করে বলছে, কী দরকার ছিল সঞ্জয়ের এসব করার, বাড়িতে ওর দু-দুটো বড় মেয়ে, ছি ছি! (হাসি)