• বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদে কি ফের নীতীশই? ‘নীরবে’ অঙ্ক কষছে দুই শিবির
    এই সময় | ১৬ নভেম্বর ২০২৫
  • এই সময়, নয়াদিল্লি: ‘বিহার কে সিএম পোস্ট মে কোই ভ্যাকেন্সি নেহি হ্যায়!’

    শনিবারের বারবেলায় পাটনায় নীতীশ কুমারের বাসভবনে বসে মিনিট চল্লিশের বৈঠক সেরে যখন বেরোচ্ছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজীব রঞ্জন (লালন) সিং, তখন মিডিয়ার উদ্দেশে এই কথাটাই ছুড়ে দিতে দেখা গেল তাঁকে। জেডিইউ-র অন্যতম শীর্ষ নেতা লালন সিংকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদে নীতীশই বহাল থাকবেন? জবাবে উড়ে আসে এক লাইনের জবাব— বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদ ফাঁকা নেই!

    অর্থাৎ বার্তাটা স্পষ্ট, বিহারের সিএম পদে নীতীশ কুমার ছাড়া আর কাউকেই মানতে রাজি নয় তাঁর দল। নীতীশের নেতৃত্বে বিহার ভোটে এনডিএ লড়বে— নির্বাচনী প্রচারে এই কথা একাধিকবার শোনা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মুখে। কিন্তু নীতীশকে কোনও ভাবেই মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরেনি বিজেপি। শুক্রবার ভোটের রেজ়াল্টের পরও সিএম ফেস নিয়ে একটি কথাও শোনা যায়নি মোদী–শাহের মুখে। নীতীশও আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব! এর মধ্যে লালন সিংয়ের এই তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, লালনের এই মন্তব্য আদতে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের উদ্দেশে। বিহারের ভোটে ৯০ শতাংশ স্ট্রাইক রেট নিয়ে ৮৯টি আসনে জয়ী হওয়া বিজেপির শীর্ষ নেতারা যাতে কোনও ভাবেই মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে নীতীশকে সরানোর কথা না ভাবেন, তা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই এ কথা বলেছেন মোদী সরকারে ক্যাবিনেট মন্ত্রী এবং নীতীশের ‘ডান হাত’ লালন।

    কিন্তু নীতীশকে সরানোর কথা উঠছে কেন?

    বিহারের প্রত্যাবর্তন বনাম পরিবর্তনের লড়াইয়ে এনডিএ জোটের দুরন্ত সাফল্যের ২৪ ঘণ্টা পরেও জোটের তরফে কোনও সাংবাদিক বৈঠক করা হয়নি। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা দিল্লি থেকে পাটনা উড়ে গিয়ে নীতীশকে শুভেচ্ছা জানাননি বা দশমবার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসানোর আভাসও দেননি। তাতেই প্রশ্ন উঠছে, তবে কি শেষ মুহূর্তে মহারাষ্ট্র ফর্মুলা প্রয়োগ করবে বিজেপি? ২০২৪–এ একনাথ শিন্ডের নেতৃত্বে এনডিএ জোট মহারাষ্ট্র বিধানসভা ভোটে লড়লেও শেষ পর্যন্ত বিজেপির দেবেন্দ্র ফড়নবীশকেই মুখ্যমন্ত্রী পদে বসানো হয়। বিহারেও সেই আশঙ্কাই দানা বাঁধছে।

    আর তাই নীতীশের দল জেডিইউ ৮৫টি আসন পেয়েও অত্যন্ত সাবধানী৷ সূত্রের খবর— জল মাপছেন নীতীশ নিজেও৷ যতই তাঁর বাসভবনের বাইরে ‘টাইগার অভি জি়ন্দা হ্যায়’-র পোস্টার পড়ুক, ভোটের ফল বেরোনোর পরে নীতীশ নিজে কোনও বিবৃতি দেননি৷ তাঁর এই নীরবতা অত্যন্ত ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করা হচ্ছে৷ ৭৪ বছরের নীতীশের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, সিএমের মসনদ টিকিয়ে রাখার জন্য জোট বদলাতে দ্বিতীয় বার ভাবেন না তিনি। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে বিজেপির কোনও চমকের পাল্টা দিতে ‘পাল্টুরাম’ নীতীশও তাঁর হাতে থাকা ১২ জন সাংসদকে নিয়ে ভেল্কি দেখাতে পারেন, এমনটাই দাবি জেডিইউ সূত্রে৷ নীতীশের এই নীরবতাকে তাই সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবেই দেখছে তাঁর দল৷

    এই আবহেই শনিবার সকালে পাটনায় নীতীশ কুমারের বাসভবনে উপস্থিত হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং এলজেপি (রামবিলাস) নেতা চিরাগ পাসোয়ান৷ ২৯টি আসনে লড়াই করে ১৯টিতে জিতেছে চিরাগের দল৷ এই খুশির মুহূর্তে শনিবার নীতীশকে উত্তরীয় পরিয়ে, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন চিরাগ৷ ভোটের আগে একাধিক খুন ও অপরাধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিহারের আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন চিরাগ। তখন জল্পনা ছড়িয়েছিল, এনডিএ–তে জোটসঙ্গী হলেও আদতে নীতীশ ও চিরাগের মধ্যে সুসম্পর্ক নেই। কিন্তু এ দিন মিডিয়ার প্রশ্নের উত্তরে চিরাগ খোলাখুলিই জানান, নীতীশেরই বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসা উচিত!

    তবে জোটসঙ্গীরা যাই বলুক, বিজেপিকে না আঁচালে বিশ্বাস নেই। আর তাই সিএম পদে নীতীশের নাম ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই তাঁর দলে। ২৪৩ আসনের বিহার বিধানসভায় সরকার গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় ম্যাজিক ফিগার ১২২। বিজেপি বা আরজেডি কোনও দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তবে একটি সূত্রের দাবি, ৮৯ আসনে জেতার যুক্তিতে নিজের দলের লোককে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী মসনদে বসানোর চেষ্টা করতে পারে বিজেপি। আর নীতীশ তাতে রাজি না হলে জেডিইউ–র কয়েকজন বিধায়ককে ভাঙিয়ে, ১৯টি আসন পাওয়া এলজেপি, ৫টি আসন পাওয়া জিতন রাম মাঝির হাম এবং ৪টি আসন পাওয়া উপেন্দ্র কুশওয়াহার আরএলএম-কে সঙ্গে নিয়ে সরকার গড়তে পারে বিজেপি। সেক্ষেত্রে আসাদউদ্দিন ওয়াইসির দলের জেতা পাঁচটি আসন এবং বসপার একটি আসনও বিজেপির সহায়ক হতে পারে।

    কিন্তু বিজেপি যদি সেটা করে, তা হলে চুপ করে বসে থাকবে না জেডিইউ, সাফ জানিয়ে দিয়েছে নীতীশের দল। শনিবার জেডিইউ–র দলীয় সূত্রে খবর, এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে নিজেদের হাতে থাকা ৮৫টি আসন নিয়ে লালুপ্রসাদ যাদবের বাসভবনে গিয়ে কড়া নাড়তে পিছপা হবেন না নীতীশ। আরজেডি–কংগ্রেসের মহাগঠবন্ধনের ঝুলিতে রয়েছে ৩৫টি আসন। সেক্ষেত্রে নির্দল বা বসপার সাহায্য নিয়ে সরকার গঠনের দাবি জানাতে অসুবিধা হবে না নীতীশের! এই সম্ভাবনা এবং অঙ্কের কথা ভালোই জানেন বিজেপির শীর্ষ নেতারাও৷ ফলে জল মাপছেন তাঁরাও। শনিবার রাতেই অমিত শাহের বাড়িতে জেপি নাড্ডা ও লালন সিংয়ের উপস্থিতিতে গোপন বৈঠকের খবর মিলেছে।

    বিহারের বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২২ নভেম্বর। সেদিন বা তার আগেই গড়তে হবে সরকার। ফলে সরকার গঠন এবং মুখ্যমন্ত্রীর শপথগ্রহণের তোড়জোড় ২–৩ দিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। তার আগে বিহার ঘিরে এখন কি ঝড়ের আগের স্তব্ধতা?

  • Link to this news (এই সময়)