ভোপাল: ভারতের নবজাগরণের অগ্রদূত। ইতিহাস, সমকালীন পত্র-পত্রিকা ও আপামর দেশবাসীর কাছে এভাবেই পরিচিত রাজা রামমোহন রায়। তবে গেরুয়া জমানার ‘স্বরচিত ইতিহাসে’ তিনি ‘ব্রিটিশদের এজেন্ট’। ধর্মান্তরণের দালাল। ভুয়ো সমাজ-সংস্কারক। রামমোহন রায়কে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী ইন্দর সিং পারমার। শনিবার তাঁর এই অসম্মানসূচক মন্তব্যে বিতর্কের আগুনে ঘি পড়েছে। ফুঁসে উঠেছে গোটা বাংলা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা, রবি ঠাকুরের জন্মস্থান ভুল বলা, স্বামী বিবেকানন্দকে বামপন্থী বলে বেফাঁস আখ্যা, কিংবা অসমে ‘সোনার বাংলা’ গাওয়া নিষিদ্ধ করা... বাংলার সংস্কৃতিকে পদদলিত করায় বিজেপি নেতারা এমনিতেই যাবতীয় সীমা ছাপিয়ে গিয়েছেন। আর এবার ইতিহাসে ‘ধর্মের রাজনীতি’র চেনা সিলেবাস ঢোকাতে গিয়ে ভোটের মুখে বঙ্গ বিজেপির পায়ের তলার মাটিই কার্যত সরিয়ে দিলেন গেরুয়া মন্ত্রী। একযোগে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটাল কংগ্রেস, তৃণমূল সহ বিরোধীরা। তৃণমূল কংগ্রেস সাফ জানিয়েছে, ‘বাংলার মহাপুরুষদের প্রতি বিজেপির ঘৃণা ও অশ্রদ্ধার সীমা নেই। অমিত শাহর র্যালির সময় বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙচুর থেকে শুরু করে বিবেকানন্দকে অবমাননা। সবেতেই বাংলা বিদ্বেষ।’ মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস মুখপাত্র ভূপেন্দ্র গুপ্ত বলেন, ‘ভারতের সংস্কারের ইতিহাসকে অপমান করা হয়েছে। তাহলে সতীদাহ প্রথার বিলুপ্তি কি ব্রিটিশদের হয়ে দালালি ছিল?’ সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর আক্রমণ, ‘সাধে কি জ্যোতি বসু বিজেপিকে অসভ্য-বর্বরদের দল বলতেন? ব্রিটিশের কাছে মুচলেকা দেওয়া সাভারকর ওদের বীর! আর বাংলার সত্যিকারের বীর ওদের কাছে দালাল!’ অগত্যা চাপে পড়ে রাতারাতি পালটি খেলেন মন্ত্রীমশাই। রবিবার এক ভিডিয়োবার্তায় ক্ষমা চেয়ে তিনি বলেন, ‘ভুলবশত এই মন্তব্য করে ফেলেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে শ্রদ্ধা করি।’
শনিবার মধ্যপ্রদেশের আগর মালওয়ায় বীরসা মুণ্ডার ১৫০তম জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষামন্ত্রী। সেখানেই তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশদের নির্দেশে কাজ করতেন রামমোহন রায়। ঔপনিবেশিক শাসনকালে ইংরেজি শিক্ষার অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে জনগণের ধর্মান্তরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল তাঁর। তখন শিক্ষাগ্রহণের প্রাথমিক মাধ্যম ছিল ব্রিটিশচালিত মিশনারি স্কুলগুলি। আর সেখানে ষড়যন্ত্র করে ধর্মান্তরণের চক্র চালানো হত। তার অন্যতম এজেন্ট ছিলেন রামমোহন রায়। বীরসা মুণ্ডাও পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে তিনি স্কুল ছেড়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। আর এই চক্র বন্ধ করার জন্য লড়েন।’ তবে এই প্রথম নয়। উচ্চশিক্ষামন্ত্রীর আগেও এমন ‘কীর্তি’ রয়েছে। এর আগে তিনি বলেছিলেন—ভারত অবিষ্কারের নেপথ্যে ভাস্কো-দা-গামা নন। ছিলেন চন্দন নামে এক বণিক! এবার তো সব সীমা পার করলেন তিনি।
বিজেপি নেতারা একদিকে বাংলার মনীষীদের অপমান করছেন, অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদি বাংলায় ভোট চাইতে এসে বাংলার সেই মনীষীদের নাম নিচ্ছেন। এ কেমন দ্বিচারিতা! এই প্রশ্নই তুলেছে তৃণমূল। রাজ্যসভার সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, মন্ত্রী শশী পাঁজা, তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ একযোগে বলেছেন, ‘বিজেপি বাংলা ও বাঙালি বিরোধী। তা নাহলে সমাজ সংস্কারের অগ্রণী মনীষী রাজা রামমোহন রায়কে অপমান করে! এর যোগ্য জবাব মিলবে ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটে।’ সরব হয়েছেন বাংলা পক্ষের সাধারণ সম্পাদক গর্গ চট্টোপাধ্যায়ও। তিনি জানান, ‘এই মন্তব্যের মাধ্যমে বাংলার প্রতি হিন্দি বলয়ের চরম ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে।’ ইতিমধ্যেই অবশ্য মন্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছে মধ্যপ্রদেশ রাজ্য বিজেপিও। দলের মুখপাত্র শিবম শুক্লা জানান, ‘এটি মন্ত্রীর ব্যক্তিগত মন্তব্য। দেশের সকল মনীষীকে সম্মান করে বিজেপি।’