দিনে হাজারেরও বেশি পুশব্যাক! সীমান্তে ক্যাম্প করে যাচাই, আধার-ভোটার সিজ বিএসএফের
বর্তমান | ১৯ নভেম্বর ২০২৫
শ্যামলেন্দু গোস্বামী, হাকিমপুর সীমান্ত: এসআইআর আতঙ্কে বাংলাদেশ ফেরার হিড়িক অনুপ্রবেশকারীদের! এমন ঘটনা আর বিক্ষিপ্ত নয়। সীমান্ত এলাকায় এটাই এখন নিত্য-চিত্র। শয়ে শয়ে মানুষের ভিড়। কেউ বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে, কেউ একরত্তি সন্তান। ফিরতে চায় তারা। কাঁটাতার পেরিয়ে। বৈধ পাসপোর্ট তাদের নেই। পেটের টানে, কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রাণভয়ে এপার বাংলায় এসে পড়েছিল তারা। এসআইআর ঘোষণার পর জেল আর সর্বস্ব খোয়ানোর ভয় চেপে বসেছে তাদের বুকে। তাই তাদের গন্তব্য মূলত স্বরূপনগরের বিথারি-হাকিমপুর চেকপোস্ট। অগতির গতি, বিএসএফ। সীমান্তরক্ষী বাহিনীই ত্রিপল খাটিয়ে তাদের বসিয়ে রাখছে, বাংলাদেশের নথি যাচাই করছে, ওপারের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) থেকে সবুজ সংকেত নিচ্ছে... তারপর ‘পুশব্যাক’।
কেউ সদ্য এসেছিল এপারে। কেউ একযুগ আগে। কিন্তু এখন প্রত্যেকের নিয়তি বাঁধা হয়ে গিয়েছে একই সীমান্তে। নামেই শিবির... সেখানে কেউ অপেক্ষা করছে দু’দিন ধরে, কেউ সাতদিন। সরকারিভাবে স্বীকারোক্তি না মিললেও স্থানীয় সূত্রের খবর, প্রতিদিন এক হাজারেরও বেশি ‘বাংলাদেশি’ কাঁটাতার পেরিয়ে চলে যাচ্ছে ওপারে। এটা অবশ্য বিএসএফ ও চোরাপথ মিলিয়ে। ‘চোরাপথ’ বলতে? স্বরূপনগর সীমান্তের যে এলাকাগুলিতে কাঁটাতার নেই। স্থানীয়রা বলছেন, চোখে পড়ার মতো বেড়ে গিয়েছে বিএসএফের নজরদারি। উত্তর ২৪ পরগনার এই অঞ্চল বিএসএফের ১৪৩ নম্বর ব্যাটালিয়নের অধীন। বাংলাদেশের ‘জিরো পয়েন্ট’ বলে পরিচিত সোনাই নদী। চেকপোস্টের পাশে বড় বড় গাছ। এখানকার দৃশ্যটা এখন পরিচিত নয়। কারণ, এই গাছগুলোর নীচে সার দিয়ে শুয়ে রয়েছেন কয়েকশো ‘বাংলাদেশি’। এখানে মাথার উপর ছাউনিটুকুও নেই। কেউ কম্বল, কেউ আবার আধময়লা সোয়েটার গায়েই মাটিতে পড়ে রয়েছেন। মিলছে না পর্যাপ্ত খাবার। তবুও তাঁরা মরিয়া... বাড়ি ফিরতে হবে। কাঁটাতারের ওপারে। বিএসএফ এসে হাতেগোনা কয়েকজনের থেকে বাংলাদেশের কাগজ নিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে বিজিবিকে। সেই নথি তারা যাচাই করছে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিকে দিয়ে। তারপর বাংলাদেশে প্রবেশের সময় সেই ব্যক্তির বিস্তারিত তথ্য নথিভুক্ত করছে বিজিবি। সঙ্গে উল্লেখ করা হচ্ছে ওই জনপ্রতিনিধির পরিচয় এবং ফোন নম্বরও। একইভাবে প্রত্যেক ‘পুশব্যাকে’র তথ্য নথিভুক্ত করছে বিএসএফও। অর্থাৎ, কতজন বাংলাদেশি ওপারে ফিরে যাচ্ছে, তাদের খুঁটিনাটি সবটাই রেজিস্টার করছে বিএসএফ। তবে একসঙ্গে ২০০ মানুষের তথ্য যাচাইয়ের পর ‘ছাড়া’ হচ্ছে অনুপ্রবেশকারীদের। ততক্ষণ অপেক্ষা। এখানেই শেষ নয়। এপারে থাকাকালীন কোনও বাংলাদেশি যদি ঘুরপথে আধার-ভোটারের মতো ভারতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে থাকে, সেই সব ‘সিজ’ করে নিচ্ছে বিএসএফ। তারপর মিলছে ‘ফেরার ছাড়পত্র’।
চেকপোস্টের সামনে গাছতলায় ছ’মাসের সন্তান কোলে বসেছিলেন রুবিনা বিবি। বললেন, ‘আমরা দু’বছর আগে গিয়েছিলাম ডানকুনিতে। কাজের জন্য... দালাল ধরে। এখন এসআইআর নিয়ে এত কড়াকড়ি হতে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। স্বামী ও একরত্তি মেয়েকে নিয়ে দু’দিন ধরে অপেক্ষা করছি। বাংলাদেশের কাগজ বিএসএফ নিয়ে গিয়েছে।’ ষাটোর্ধ্ব আব্বাস আলির কথায়, ‘করোনার আগে দালাল ধরে নিউটাউনে গিয়েছিলাম। রাজমিস্ত্রির কাজ করতাম। স্ত্রী অন্যের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করত। ছেলেমেয়ে আছে বাংলাদেশের সাতক্ষীরার বাড়িতে। হঠাৎ শুনলাম, সব নথি যাচাই হবে। ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। ভারতের কোনও নথিই তো আমার নেই। বাংলাদেশের আছে। সব জমা দিয়েছি।’ সামিনা খাতুনের বাংলাদেশের সব নথির পাশাপাশি ‘ভারতীয় পরিচয়পত্র’ও নিয়ে গিয়েছে বিএসএফ। মঙ্গলবার সকালে। বলছিলেন, ‘বিএসএফ বলেছে, সোনাই নদী পার করিয়ে দেবে। তারপরই আমরা চলে যাব খুলনার বাড়িতে।’ বিএসএফের এক কর্তা বলেন, ‘কেউ এলেই তো আর তাকে বাংলাদেশে পাঠানো যায় না। এর জন্য সরকারি নিয়ম মেনে নথি যাচাই করতে হয়। ফলে সময় লাগছে। বিজিবির থেকে রিপোর্ট আসার পর ২০০ জন করে আমরা সোনাই নদী পার করাচ্ছি। দিনে দু’-তিনবার। কেবলমাত্র এই সীমান্ত থেকে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে বলেই এত চাপ।’
সূত্রের খবর, স্বরূপনগরের আমুদিয়া এলাকায় প্রায় ৬ কিমি সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতার নেই। রাতে বিএসএফের নজরদারি থাকে। পাশাপাশি বিজিবিও টহল দেয়। এসআইআর আবহে নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ‘দালাল’রা। তবে চোরাপথে কেউই বাংলাদেশে যেতে পারছে না বলেই সাফ দাবি বিএসএফের।