একাধিক বিতর্কের মাঝেই একাদশ–দ্বাদশ শিক্ষক নিয়োগে নথি যাচাই শুরু
দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৯ নভেম্বর ২০২৫
একদিকে দুর্নীতির জেরে চাকরি হারানো যোগ্য প্রার্থীরা, অন্যদিকে বহু বছর পর পরীক্ষা দিয়ে নতুন করে সুযোগের অপেক্ষায় থাকা তরুণ–তরুণীরা। দু’পক্ষকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে মঙ্গলবার থেকে শুরু হল একাদশ–দ্বাদশ শিক্ষক নিয়োগের নথি যাচাই পর্ব। করুণাময়ীতে স্কুল সার্ভিস কমিশনের নতুন ভবনে প্রথমদিন থেকেই বাংলা বিভাগের প্রায় সাতশোরও বেশি তালিকাভুক্ত প্রার্থীর নথি যাচাই করা হয়। পনেরোটি টেবিলে একে একে প্রার্থীদের ডেকে নথি দেখা হলেও, চাপা অস্বস্তি লক্ষ্য করা গিয়েছে। রয়েছে ক্ষোভ আর দীর্ঘদিনের অপেক্ষার যন্ত্রণা।
২০১৬ সালে বৈধভাবে চাকরি পেয়েও দুর্নীতির রায় অনুসারে চাকরি হারানো প্রায় ১৩ হাজার যোগ্য প্রার্থী আবারও লাইনে দাঁড়িয়ে নথি যাচাই করালেন। তাঁদের পাশে বসেছিলেন ২০২৬ সালের নতুন পরীক্ষার্থীরা। যাঁদের আপত্তি, যোগ্য চাকরিহারাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বাড়তি দশ নম্বর দেওয়া হয়েছে।
একজন নতুন পরীক্ষার্থীর কথায়, যে প্যানেলই শেষ পর্যন্ত বাতিল হল, সেই প্যানেলের অভিজ্ঞতার ওপর দশ নম্বর দেওয়া কতটা ন্যায্য? ইন্টারভিউতেও আবার নম্বর পাবেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আগের বার পরীক্ষা দিতে পারিনি, আমাদের দোষ কোথায়?’
অপরদিকে, যোগ্য চাকরিহারা প্রার্থীদের অভিযোগ— দশ নম্বর নয়, তাঁদের আরও বেশি নম্বর দেওয়া উচিত ছিল। যোগ্য চাকরিহারা আন্দোলনের অন্যতম মুখ মেহেবুব মণ্ডলের দাবি, তাঁরা আবার এই জায়গায় ফিরতে চাননি। খুব দুঃখজনক। অপরাধ না-করে চাকরি হারাতে হয়েছে। মোট ৩২ হাজার আসনে নতুনদের জন্য প্রচুর সুযোগ রয়েছে। তাঁর দাবি, ‘আমাদের ন্যায্য প্রাপ্যটুকুই চাই।’
মঙ্গলবার নথি যাচাই পর্বে দেখা গেল এক অনন্য দৃশ্য। কোলের সন্তান নিয়ে হাজির হয়েছেন বহু চাকরিহারা শিক্ষিকা। যাঁরা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পরীক্ষা দিয়েছিলেন, এমনকি চাকরি বাতিলের রায় বেরোনোর সময়ও ছিলেন গর্ভবতী। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সোনারপুরের এক মহিলা চাকরিপ্রার্থী একমাসের শিশুকে কোলে নিয়ে এসেছেন নথি যাচাইয়ে। চোখ ভিজিয়ে তিনি বলেন, অসুস্থ শরীরে পরীক্ষা দিয়েছি। এখনও নিশ্চিত নই চাকরি পাব কি না। ভেতরে নথি দেখা হলেও কোনও রিসিভ কপি দিল না। বারবার মনে হচ্ছে, আমাদের জোর করে আগুনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।’
ওই চাকরিপ্রার্থীর স্বামী পেশায় কলেজের অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘চাকরি হারিয়ে স্ত্রী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। লোন, গর্ভাবস্থা… সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ ছিল। আজ নথি দেখা হল ঠিকই, কিন্তু চাকরি ফিরে পাবেন কি না, তা জানা নেই।’
একইভাবে হুগলির মানকুণ্ডুর এক মহিলা চাকরিপ্রার্থীও নবজাতক সন্তানকে কোলে নিয়ে হাজির হয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘আমরা সৎ, তার পরও পরিস্থিতির শিকার। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পরীক্ষা দিয়েছি। আজ ভেরিফিকেশন ভালো হয়েছে। ভেতরের সবাই সহযোগিতা করেছেন।’
মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার এক প্রতিবন্ধী চাকরি প্রার্থী লাঠিতে ভর দিয়ে এসেছেন নথি যাচাইয়ে। শৈশবের জ্বর থেকে শুরু হওয়া অসুস্থতা তাঁকে পোলিওগ্রস্ত করে রেখেছে। সেজন্য লাঠিতে ভর দিয়ে তাঁকে চলতে হয়। তিনি জানান, ‘২০১৬-তে পাশ করতে পারিনি। এবার অনেক প্রস্তুতি নিয়ে পাশ করেছি। ভেরিফিকেশন ভালো হয়েছে। সার্টিফিকেট রিনিউয়ালের একটি সমস্যা ছিল, সেটা ঠিক করে নিতে বলেছে।’ যোগ্য চাকরিহারাদের অতিরিক্ত নম্বর দেওয়ার বিষয়ে তাঁর বক্তব্য— ‘ওঁদের অভিজ্ঞতা আছে, তাই নম্বর দেওয়া উচিত। আসন সংখ্যা বাড়ালে ভালো হয়।’
যদিও চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ১০ নম্বর দেওয়া নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। নথি যাচাইয়ের সারিতে দাঁড়িয়ে অদ্ভুতভাবে দেখা গেল সহানুভূতির সুর। কেউ কারও শত্রু নন। সবারই একটাই লক্ষ্য, একই উদ্বেগ— চাকরি। দ্বন্দ্ব, যন্ত্রণা, সহানুভূতি— সব মিলিয়ে এক অনিশ্চিত পরিবেশ। প্রত্যেকেরই নিজের লড়াই আছে। কেউ নতুন করে ভবিষ্যৎ গড়ার আশায় রয়েছেন, কেউ মুঠো থেকে খসে যাওয়া জীবনের স্বপ্ন ফিরিয়ে আনার যুদ্ধে সামিল হয়েছেন।
পরীক্ষা যেমন হয়েছে মিলেমিশে, নিয়োগ তেমনই হবে। এমনটাই মনে করছেন অনেকে। তবে শেষ কথা বলবে কমিশনের রিপোর্ট, আদালতের রায় এবং সরকারের সিদ্ধান্ত।