• মানস ভুঁইয়ার উদ্যোগে ‘শোর’ প্রকল্প নিয়ে বৃহৎ স্টেকহোল্ডার বৈঠক
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৯ নভেম্বর ২০২৫
  • সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ রক্ষা, উপকূলবর্তী অঞ্চলের পরিবেশগত সুরক্ষা এবং মানুষের জীবিকা উন্নয়নের লক্ষ্য সামনে রেখে রাজ্য সরকার যে বৃহৎ উদ্যোগ হাতে নিয়েছে, সেই উদ্যোগের অন্যতম স্তম্ভ হল ‘শোর’ প্রকল্প। এই প্রকল্পকে ঘিরে সোমবার সল্টলেকের কেএমডিএ অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় এক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শসভা, যেখানে উপস্থিত ছিলেন সেচ ও জলপথ এবং জলসম্পদ ও উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী মানস রঞ্জন ভুঁইয়া। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ওই দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন, সুন্দরবন মন্ত্রী বঙ্কিম চন্দ্র হাজরা,সাংসদ প্রতিমা মণ্ডল ও বাপি হালদার, অ্যাডিশনাল চিপ সেক্রেটারি অত্রী ভট্টাচার্য , মনিশ জৈন ,প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি অঙ্কর সিং মিনা সহ একাধিক দপ্তরের উচ্চপদস্থ আধিকারিক এবং উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রতিনিধিরা। সুন্দরবনের পরিবেশগত সঙ্কট ও সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে এই আলোচনা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

    মানস ভুঁইয়া তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেন যে গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র নদীর মোহনা এবং ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা সুন্দরবন কেবল পশ্চিমবঙ্গেরই নয়, গোটা দেশের পরিবেশগত নিরাপত্তার অন্যতম ভিত্তি। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্যের এই অঞ্চল মানুষের জীবিকা, কৃষি, মৎস্যচাষ, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। দুই ২৪ পরগনা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ছোট-বড় নদী, খাঁড়ি এবং বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল মিলিয়ে সুন্দরবনের উপকূলবর্তী এলাকা দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। ৫৫০টিরও বেশি দ্বীপ ও চর নিয়ে গঠিত এই অঞ্চলের মধ্যে ৪৮টি দ্বীপে মানুষের বসতি রয়েছে, বাকি দ্বীপগুলি সম্পূর্ণভাবে জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অতিবৃষ্টি, তাপমাত্রার পরিবর্তন ও নদীর জলধারার পথচিহ্ন বদলে যাওয়ার ফলে এই অঞ্চলের ভূমিক্ষয় এবং পরিবেশগত ক্ষতি ভয়ঙ্কর মাত্রায় পৌঁছেছে।

    মিঠে জলের প্রবাহ ক্রমশ কমে যাওয়ায় বহু নদী ও খাঁড়ি কার্যত মরা খালে পরিণত হয়েছে। ফলে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কৃষির উৎপাদন কমছে, মৎস্যচাষ ব্যাহত হচ্ছে এবং বনজ সম্পদও নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি উন্নয়নের প্রয়োজন মেটাতে নির্মিত সড়ক, ঘাট, বাঁধ এবং পরিবহন ব্যবস্থাও কখনও কখনও পরিবেশগত ভারসাম্যে চাপ সৃষ্টি করছে। এই সবকিছুর সামগ্রিক মোকাবিলাই ‘শোর’ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য।

    বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে প্রণীত এই প্রকল্পে পরিবেশবান্ধব বাঁধ নির্মাণ, নদী পুনরুজ্জীবন, জলাশয় সংরক্ষণ, মিঠে জলের আধার বৃদ্ধি, লবণ–সহনশীল মাছ চাষের বিস্তার, কৃষকের উৎপাদনক্ষমতা উন্নয়ন, বনধারী গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন, কৃষক গোষ্ঠী ও জল ব্যবহারকারী সমিতির পুনর্গঠন— এই সবকিছুকে লক্ষ্য ধরে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। একই সঙ্গে ইকো–ট্যুরিজমের প্রসার, ক্ষুদ্র শিল্পের উন্নয়ন, মৌচাষ, উদ্যানপালন, সড়ক ও সেতু নির্মাণ— প্রতিটি ক্ষেত্রেই সামগ্রিক উন্নয়নের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন দপ্তর সমন্বিতভাবে এই প্রকল্পের বাস্তবায়নে যুক্ত থাকবেন বলে জানানো হয়।

    মানস ভুঁইয়া জানান, প্রকল্পটি ইতিমধ্যেই মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়েছে। প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় চার হাজার কোটি টাকা, তবে বাজারদরের ভিত্তিতে সেই ব্যয় কিছুটা বাড়তে পারে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ঋণ হিসেবে মোট ব্যয়ের সত্তর শতাংশ প্রদান করবে, বাকি ত্রিশ শতাংশ বহন করবে রাজ্য সরকার। বর্তমানে প্রকল্পের অনুমোদন কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন। তবে এখানে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন যে কেন্দ্র সরকার এত বৃহৎ পরিবেশগত প্রকল্পে বিশেষ কোনো সহায়তার বার্তা দেয়নি। কেন্দ্রের তরফে প্রকল্প অনুমোদনের গতি অত্যন্ত ধীর, ফলে বাস্তবায়ন পিছিয়ে যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে মানস ভুঁইয়া জানান যে সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ রক্ষা কোনও রাজ্যের একার দায় নয়, এটি গোটা দেশের পরিবেশগত সুরক্ষার অংশ। তাই কেন্দ্রের সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। তিনি জানান, এই বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীকে ব্যাখ্যা করবেন এবং কেন্দ্রের কাছে দ্রুত অনুমোদনের আবেদন তোলার বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করবেন।

    রাজ্যস্তরে ইতিমধ্যেই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য গঠিত হয়েছে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রযুক্তিগত পর্ষদ, যার প্রধান রাজ্যের মুখ্যসচিব। বিভিন্ন দপ্তরের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব ও দপ্তরপ্রধানরা এই পর্ষদের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। প্রতিটি দপ্তরই তাদের আলাদা কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করেছে এবং জনপ্রতিনিধিদের মতামতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত রূপরেখা নির্ধারণ করা হচ্ছে। নদী সংস্কার, বনায়ন, বাঁধের আধুনিকীকরণ, সড়ক ও সেতু নির্মাণ, ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প, মৎস্যচাষের বিকাশ, কৃষি উন্নয়ন, বনরক্ষা সমিতির পুনর্গঠন— সব ক্ষেত্রেই সমন্বিতভাবে কাজ চালানো হবে।

    পরামর্শসভায় উপস্থিত জনপ্রতিনিধিরা জানান যে সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ রক্ষা কেবল পরিবেশগত সুরক্ষাই নয়, মানবিক দায়িত্বও। দীর্ঘদিন ধরে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় মানুষ তাদের বসতভিটা হারাচ্ছেন, অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়ছে। তাই ‘শোর’ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জীবিকার নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে, কৃষি ও মৎস্যচাষে উন্নতি হবে, নদীর গতিপথ পুনরায় স্থিতিশীল হবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উপকূলবর্তী অঞ্চল আরও নিরাপদ হবে।

    মানস ভুঁইয়া বলেন, সুন্দরবনের প্রতিটি দ্বীপ, প্রতিটি নদী, প্রতিটি খাঁড়ি আমাদের কাছে অমূল্য সম্পদ। প্রকৃতি এবং মানুষের মধ্যকার এই সহাবস্থানকে শক্তিশালী করতে হবে। তিনি আশাবাদী যে কেন্দ্রীয় সরকার অবশেষে প্রকল্পের অনুমোদন দেবে এবং রাজ্য ও কেন্দ্র একযোগে এই বিশাল পরিবেশগত প্রচেষ্টাকে সফল করবে। তিনি বলেন, অনুমোদন মিললেই ‘শোর’ প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করা দ্রুত সম্ভব হবে এবং সুন্দরবন এক নতুন অধ্যায়ের দিকে এগিয়ে যাবে।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)