কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া কৃষি আইন চালুর চেষ্টার বিরুদ্ধে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে উত্তর ভারতে হয়েছে কৃষক আন্দোলন। তাঁদের অভিযোগ ছিল, বহুজাতিক এবং বড় ব্যবসায়ীদের সুবিধা পাইয়ে দিতেই এই নয় আইন। পাঁশকুড়ার চন্দ্রমল্লিকা বাগান সাম্প্রতিক কালে যে ভাবে ভিন্ রাজ্যের বড় ব্যবসায়ীরা লিজ় নিচ্ছে, তাতে এই নয়া কৃষি আইনেরই প্রতিচ্ছবি দেখছেন অনেকে। এই পদ্ধতিতে বাড়তি লাভের আশায় কৃষকেরা জমি অন্যকে লিজ় দিচ্ছেন ঠিকই। তবে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টাকা না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন বলেও দাবি। আর ওই চুক্তিভিত্তিক চাষের ফলে এলাকার বহু ফুল ব্যবসায়ী প্রায় কাজ হারাতে বসেছেন।
নতুন কৃষি আইনে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের দাবি করেছিল, এই আইন কার্যকর হলে কৃষি ক্ষেত্রে ফড়েদের একচ্ছত্র রাজ কমে আয় বাড়বে কৃষকের। রাজ্যগুলিতে চুক্তিভিত্তিক চাষের আইনি স্বীকৃতি মিলবে এবং কৃষি পণ্য কেনাবেচায় আন্তঃরাজ্য অবাধ বাণিজ্যের রাস্তা খুলে যাবে। পাঁশকুড়ার চন্দ্রমল্লিকার ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক চাষেরই প্রাধান্য পাচ্ছে। ফুল ফোটার আগেই বাগানকে চুক্তির ভিত্তিতে ভিন্ রাজ্যের বড় ফুল ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন স্থানীয় চাষিরা।
অবশ্য একাংশ কৃষক অভিযোগ করছেন, গত বছরগুলিতে বেশ কিছু কৃষক চুক্তি অনুযায়ী ব্যবসায়ীদের থেকে প্রথম ফুল তোলার সময় ২০ শতাংশ হারে এককালীন টাকা পেলেও পরে বাকি টাকা পাননি। কোনও ব্যবসায়ী আবার লোকসান হয়েছে বলে, টাকা দিতে অস্বীকার করেছেন। ওই ব্যবসায়ীরা অন্য রাজ্যে থাকায় ছোট চাষিরা প্রতারিত হচ্ছেন বুঝতে পেরেও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তিরা এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় মুখলজ্জার খাতিরে টাকা আনতে গিয়েও খালি হাতে ফিরে এসেছেন বলে দাবি।
এ দিকে, লিজ় ব্যবসায় প্রভাবিত হয়েছেন এলাকার ছোট ফুল ব্যবসায়ীরাও। পাঁশকুড়া ও কোলাঘাটের ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা দিল্লি, ওড়িশা, উত্তর প্রদেশে জেলার বাগানগুলি থেকে সরাসরি ফুল পাঠাতেন। বড় ব্যবসায়ীরা এলাকায় এসে জমি লিজ়ে নিয়ে চাষ করায় তুলনামূলক কম পুঁজির ব্যবসায়ীরা আর ফুল ভিন্ রাজ্যে পাঠাতে পারেননি। ফলে তাদের রুজি-রুটিতেও টান পড়ছে। অনেকে পেশাও বদল করছেন।
মহৎপুরের চাষি দিলীপ পাল বলেন, ‘‘বছর তিনেক আগে নিজের বাগান দিল্লির এক ব্যবসায়ীকে লিজ়ে দিয়েছিলাম। ২০ শতাংশ টাকা পেয়েছিলাম। বাকি টাকা আর পাইনি। তাই এখন নিজের বাগানের ফুল নিজেই আড়তে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করি।’’ দীর্ঘদিন ধরে পাঁশকুড়ার ফুল বাজার থেকে কৃষকদের ফুল নিয়ে কলকাতা ও কোলাঘাটে বিক্রি করতেন নারান্দা গ্রামের বাসিন্দা নিমাই বাড়ি। তিনি বলেন, ‘‘লিজ় পদ্ধতিতে বাগান থেকে সরাসরি চন্দ্রমল্লিকা রফতানি হওয়ায় এই ব্যবসায় যুক্ত এলাকার বহু ছোট-বড় ব্যবসায়ী কাজ হারিয়েছেন। আমিও এক প্রকার ব্যবসা ছেড়ে ঘরে বসে রয়েছি।’’
নয়া কৃষি আইনের বিরোধিতা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চন্দ্রমল্লিকা চাষে বড় ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি একাধিকবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের চাষিরা জানিয়েছেন বলে দাবি। তাতে লাভের লাভ কিছু হয়নি। যদিও ফুল চাষিদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন তৃণমূলের (তমলুক) জেলার সুজিত রায়। তিনি বলেন, ‘‘এই সমস্ত আশঙ্কা করেই দূরদর্শী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কৃষি আইনের বিরোধিতা করেছিলেন। কৃষকদের বলব, প্রতারকের পাল্লায় না পড়ে সরকারি ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে তাঁদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করলে প্রতারিত হতে হবে না।’’