মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে যখন লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প চালু করে বাজিমাত করলেন, তখন শিক্ষিত শহুরে উচ্চবিত্ত সমাজের অনেকেই ছি ছি করেছিলেন। না, তৃণমূল কংগ্রেসের নিন্দা নয়। নিন্দার মুখে পড়েছিলেন গ্রাম, আধা-শহর বা শহরের গরিব মহিলা ভোটাররা। কারণ তাঁরা নাকি রাজ্যের উন্নয়ন, শিল্প, কর্মসংস্থান, দুর্নীতি এ সবের কিছুই না ভেবে শুধু হাতে নগদ টাকার বিনিময়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছিলেন। এটাই তাঁদের ‘দোষ’!
গত লোকসভা নির্বাচনের পরে তার পুনরাবৃত্তি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা বাড়িয়ে দিলেন। এবং বিজেপিকে টেক্কা দিলেন। আবার সমালোচনার মুখে পড়লেন সাধারণ মহিলা ভোটাররা। তাঁদের ‘দোষ’ হল, তাঁরা মাসিক ১ হাজার টাকা হাতে পেয়ে রাজ্যের ভবিষ্যতের কথা ভুলে গিয়েছেন! মহিলাদের ভোট পেয়ে তৃণমূলের ২৯টি লোকসভা আসন জয়ের ফলে রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে সমস্ত দুর্নীতি ধামাচাপা পড়েছে। অতএব গর্হিত অপরাধ করেছেন মহিলারা!
ভোটে শাসক দলের জয়ে বরাবরই দেশ বা রাজ্যের যাবতীয় সমস্যা আড়ালে চলে যায়। এই যে বিহারে নীতীশ কুমার-নরেন্দ্র মোদীর যুগলবন্দিতে এনডিএ ২৪৩ আসনের বিধানসভায় দু’শোর বেশি আসনে জিতে ক্ষমতায় ফিরল, তাতে মনে হতেই পারে, ২০ বছর ক্ষমতায় থাকা নীতীশ কুমার সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মনে কোনও নালিশ নেই। বা, বিহার শিক্ষা-স্বাস্থ্য-মানব উন্নয়নে সব রাজ্যকে পিছনে ফেলে দিয়েছে!
বাস্তব তা নয়। বরং তার উল্টো। যে কোনও সামাজিক উন্নয়নের মাপকাঠি তুলে দেখুন, বিহার দেশের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে একেবারে পিছনের সারিতে। মেয়েদের স্কুলে ভর্তির হার, মেয়েদের আঠারো বছরের আগে বিয়ে, শিশুমৃত্যুর হার, অপুষ্টি, মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া— সবেতেই বিহার শেষ সারিতে। কারখানা বা পরিষেবাক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের নিরিখেও অনেক পিছিয়ে। তার পরেও ২০ বছর ক্ষমতায় থাকা নীতীশ কুমার ফের মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন!
এই বিহার জয়ের সাফল্যে ভর করেই নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ এ বার মনে করছেন, বিজেপির পদ্মফুল এ বার পটনা থেকে গঙ্গা বেয়ে কলকাতায় গিয়ে ফুটবে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ক্ষমতা দখল নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের কাছে এখনও অধরা মাধুরী। বিজেপির অনুরাগীরা মনে করেন, ২০২১-এ কোভিডের জন্য নরেন্দ্র মোদী যথেষ্ট প্রচার করতে না পারায় তৃণমূল সুবিধা পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অমিত শাহের রাজনৈতিক কেরিয়ারে বাংলার গত বিধানসভা নির্বাচন লাল কালির দাগ। নিজে নেতৃত্ব দিয়েও শাহ বিজেপিকে জেতাতে পারেননি। তাঁর ‘দু’শো আসন’ জয়ের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত করে বিজেপি সাতাত্তরে থেমে গিয়েছিল।
এ বার? বিহারের সাফল্য কি পশ্চিমবঙ্গে আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে এগিয়ে রাখল? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখা যাক, বিহারে বিজেপি-জেডি(ইউ) নেতৃত্বে এনডিএ কী ভাবে তেজস্বী যাদব, রাহুল গান্ধীর মহাগঠবন্ধনকে টেক্কা দিল? প্রথম কারণ অবশ্যই মহিলা ভোট। নির্বাচনের মরসুমে প্রায় দেড় কোটি মহিলার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা পৌঁছে দিয়ে নীতীশ কুমার তাঁর মহিলা ভোটব্যাঙ্ক নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু সেটাই সব নয়। শুধু মহিলা ভোটে নির্বাচন জেতা যায় না। দ্বিতীয় কারণ, নীতীশের সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা থেকে পরিকাঠামোর উন্নয়ন, বিশেষত সামাজিক উন্নয়নে যথেষ্ট কাজ হয়েছে। তৃতীয় কারণ, জাতপাতের সামাজিক সমীকরণ। তেজস্বী যাদবের নেতৃত্বে আরজেডি একক দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে। কারণ তাঁর যাদব ও মুসলিম ভোট প্রায় অটুট ছিল। কিন্তু এনডিএ-র উচ্চবর্ণ, যাদব বাদে অন্য ওবিসি থেকে ইবিসি বা অতি অনগ্রসর ভোটের মেলবন্ধন ভাঙতে পারেননি। উল্টে আরজেডি ক্ষমতায় এলে যাদবদের দাপট বাড়ার আশঙ্কায় বাকি সব জাত-সম্প্রদায় এককাট্টা হয়েছে। চিরাগ পাসোয়ান তাঁর দলিত ভোটব্যাঙ্ক নিয়ে এনডিএ-র শক্তি বাড়িয়েছেন।
চতুর্থ কারণ, মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা। এনডিএ ক্ষমতায় ফিরলে নীতীশ ফের মুখ্যমন্ত্রী হবেন কি না, তা নিয়ে বিজেপি অস্পষ্টতা রেখেছিল ঠিকই, কিন্তু বিজেপির নিজস্ব কোনও নেতা নীতীশের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেননি, যাঁকে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে তুলে ধরতে পারে। অসুস্থতার জন্যও নীতীশ সহানুভূতি লাভ করেছেন। পঞ্চম কারণ, বিজেপির সাংগঠনিক শক্তির থেকে আরজেডি-কংগ্রেসের পিছিয়ে থাকা।
দেখা যাক, এই পাঁচ অঙ্কে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রথম, মহিলাদের ভোটব্যাঙ্ক ও আর্থিক অনুদান। এ ক্ষেত্রে তৃণমূল এগিয়ে থেকেই শুরু করবে। লক্ষ্মীর ভান্ডারের মোকাবিলায় বিজেপি অন্য কোনও ভান্ডার ঘোষণা করে বাড়তি টাকার লোভ দেখাতে পারে। কিন্তু গত কয়েক বছরে বিভিন্ন রাজ্যের ভোটের ফল বলছে, যে দল আগে টাকা দিয়ে দিয়েছে, তারাই সুবিধা পেয়েছে। দ্বিতীয়, পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের প্রশ্ন। শিল্প, কর্মসংস্থানে পশ্চিমবঙ্গ এখনও অন্য রাজ্যের তুলনায় পিছিয়ে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সামাজিক উন্নয়নে কিছুটা সাফল্য দাবি করতেই পারে। বিশেষত বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির তুলনায় মানব উন্নয়নের অনেক মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গ এগিয়ে। তবে আমজনতা আর্থিক পরিসংখ্যান দেখে ভোট দেয় না। মানুষের মনে কোন দল কী ধারণা তৈরি করতে পারে, তার উপরে সাফল্য নির্ভর করে।
তৃতীয়, সামাজিক সমীকরণ। পশ্চিমবঙ্গে বিহারের মতো জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট হয় না। তবে ধর্মীয় মেরুকরণ হয়। বাংলায় মুসলিমরা এককাট্টা হয়ে কাউকে ভোট দিলে সেই রাজনৈতিক দল আগেভাগেই পাশ নম্বর হাতে নিয়ে পরীক্ষায় বসে। বিজেপি ২০২১-এর ভোটের আগে সিএএ-এনআরসি প্রসঙ্গ তুলে তৃণমূলকে মুসলিম ভোটের মেরুকরণে সাহায্য করেছিল। এ বার এসআইআর বা ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনের ফলে মুসলিমদের ভোট কাটা হবে বলে আতঙ্ক তৈরি করার হাতিয়ার তুলে দিয়েছে তৃণমূলকে। উল্টো দিকে, বাঙালি হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করার বিজেপির স্বপ্নে বিজেপি নিজেই জল ঢালছে। অন্য রাজ্যে পরিযায়ী বাঙালিদের হেনস্থা, বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশি ভাষা বলা, আমিষ-নিরামিষ বিতর্ক তারই উদাহরণ। এসআইআর-এর ফলে বিজেপির মতুয়া ভোটব্যাঙ্কেও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
চতুর্থ, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা। তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অপশাসনের অভিযোগে সেই জনপ্রিয়তা ধাক্কা খেয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনও নেতা বিজেপির ঘরে এখনও নেই। বিজেপি যত হিন্দি বলয়ের নেতাদের বাংলার মাঠে নামাবে, তত বেশি করে ভোট কমতে পারে।
পঞ্চম, বিজেপির সাংগঠনিক শক্তি। যে মাপকাঠিতে বিজেপি এখনও তৃণমূলের থেকে কয়েক আলোকবর্ষ পিছিয়ে। এই পরিপ্রেক্ষিতে শুভেন্দু অধিকারীরা এসআইআর-এর উপরে অনেকটাই ভরসা করছেন। তাঁদের ধারণা, রাজ্যের ভোটার তালিকা থেকে মৃত, অন্য রাজ্যে বসবাসকারী ও ‘ডুপ্লিকেট’ ভোটারদের নাম বাদ দিলেই তাঁদের জয় নিশ্চিত। প্রাক্তন তৃণমূল নেতা হিসেবে শুভেন্দু নিশ্চয়ই টের পেয়েছেন, অতীতে বামফ্রন্ট যে ‘সায়েন্টিফিক রিগিং’ শুরু করেছিল, তৃণমূল কংগ্রেস এখন তাতে সিদ্ধহস্ত। মৃত, অন্য রাজ্যে চলে যাওয়া, বা ‘ডুপ্লিকেট’ ভোটারদের নাম চিহ্নিত করে তাঁদের হয়ে ভোট দিয়ে আসার বামফ্রন্টের খেলায় এখন তৃণমূল বাজিমাত করছে। ভোটার তালিকায় এই ভেজাল ভোটার নিয়ে বিজেপি অভিযোগ তুলছে। আর তৃণমূলের অভিযোগ, বিজেপি নির্বাচন কমিশনের সাহায্যে মুসলিম ভোটারদের একাংশকে নির্বাচনের সময় ভোটার তালিকার বাইরে রাখতে চাইছে, যাতে তৃণমূল-বিজেপি ভোটের ব্যবধান কমিয়ে ফেলা যায়। বিজেপি সত্যিই সেই চেষ্টা করলে তার মোকাবিলায় তৃণমূলের অস্ত্র হল প্রশাসন ও সক্রিয় সাংগঠনিক শক্তি। ভুললে চলবে না, বিহারে এসআইআর ঘোষণার সময়ই এর বিপদ বুঝে মমতা সকলের আগে এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন।
ক্রিকেট-দুনিয়ার প্রাচীন প্রবাদ, আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি করে আসা ব্যাটারকে পরের ম্যাচে ফের শূন্য থেকেই শুরু করতে হয়। ভোটের রাজনীতিও ঠিক তা-ই। বিহারের জয় বিজেপির মনোবল বাড়াচ্ছে। তবুও বাংলায় বিজেপিকে ফের শূন্য থেকেই শুরু করতে হবে।