বিজেপির কেষ্টুবিষ্টুরা যা-ই করুন, আজকের ফ্যাসিস্তদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রবীন্দ্রনাথই ‘হাতিয়ার’!
আনন্দবাজার | ২০ নভেম্বর ২০২৫
তাঁর লেখা ‘জনগণমন’ ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হওয়া উচিত নয়! কারণ, তিনি নাকি এটি লিখেছিলেন ব্রিটিশ রাজাকে স্বাগত জানানোর জন্য! সম্প্রতি কর্নাটকের বিজেপি সাংসদ বিশ্বেশ্বর কাগেরি এই দাবি তুলেছেন।
তাঁর লেখা ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গাওয়ার অপরাধে অসমে সম্প্রতি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে। অসমের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা এই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁর অধীনস্থ প্রশাসনকে।
তিনি বাদ পড়েছেন। তাঁর লেখা বাদ পড়েছে। উত্তরপ্রদেশের পাঠ্যবই থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। তিনি একা নন অবশ্য। আরকে নারায়ণন, সরোজিনী নাইডু, মুলকরাজ আনন্দ, জন মিল্টন, পিবি শেলিরাও বাদ পড়েছেন তাঁরই সঙ্গে। এঁদের পরিবর্তে পাঠ্যক্রমে জায়গা করে নিয়েছেন বাবা রামদেব এবং যোগী আদিত্যনাথ।
ভারতবর্ষ থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে আর্জেন্টিনার রাজধানীতে গিয়েছিলেন তিনি। সেই যাওয়ার শতবর্ষ পালন করেছে সে দেশের সরকার। সাড়ম্বরে। শ্রদ্ধার সঙ্গে।
আর্জেন্টিনার সরকারের মতো গণপ্রজাতন্ত্রী চিনও তাঁর চিনযাত্রার একশো বছর পালন করেছে সম্প্রতি। ২০২৫ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁর আবক্ষ মূর্তি বসেছে বেজিং শহরে।
তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। ভারতবর্ষের ধারণার (দ্য আইডিয়া অফ ইন্ডিয়া) অন্যতম প্রাণপুরুষ। মৃত্যুর ৮৪ বছর বাদেও একইরকম প্রাসঙ্গিক। স্বদেশে। বিদেশে। হাতেগোনা কিছু নিন্দক এবং অসংখ্য অনুরাগীর মধ্যে।
২৭ ডিসেম্বর ১৯১১। কলকাতায় বসেছিল ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন। সেই অধিবেশনে প্রথম বারের জন্যে রবীন্দ্রনাথের লেখা পাঁচ স্তবকের ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’ গাওয়া হয়। ব্রাহ্মসমাজের একটি ‘কয়্যারের দল’ যার নেতৃত্বে ছিলেন সরলাদেবী চৌধুরাণী, তাঁরা পুরো গানটি কংগ্রেসের অধিবেশনে গেয়ে শুনিয়েছিলেন। ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ এবং সমসাময়িক অন্যান্য কাগজে। ধীরে ধীরে জাতীয় জমায়েতে, ব্রাহ্ম সমাজের মিটিংয়ে, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে এবং দেশ জুড়ে কংগ্রেসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই গানটি গাওয়া শুরু হয়। চল্লিশের দশকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’র প্রথম স্তবকটি অন্যতম রণধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ ভারতবর্ষের ‘কনস্টিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি’ এর প্রথম স্তবকটি আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করে। ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০। আমরা যে দিন নিজেদের ‘সাধারণতন্ত্র’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলাম, সে দিন থেকেই সরকারি ভাবে ‘জনগণমন’ হয়ে দাঁড়ায় ভারতবর্ষের পরিচয়।
বিজেপির কর্নাটকের সাংসদ যে কথা বলছেন, সেই ধরনের কথা পরাধীন ভারতবর্ষেও ব্রিটিশদের দালালদের মুখে শোনা যেত। সেই দালালেরাই ছড়িয়ে দিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’ লিখেছেন রাজা পঞ্চম জর্জের সম্মানে। প্রাক্-স্বাধীনতা যুগের দালালদের তৈরি করা বিতর্ক নিয়ে মুখ খুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। তিনি পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করেছিলেন, গানটি ভারতভাগ্যবিধাতার উদ্দেশে রচিত। এই গানের সঙ্গে কোনও সম্রাট বা কোনও রাজার কোনও ধরনের সম্পর্ক নেই।
পাঁচ স্তবকের এই গানটির প্রথম স্তবক আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। কিন্তু বাকি চারটি স্তবকও একইরকম ভাবে এখনও ভীষণরকম প্রাসঙ্গিক। চতুর্থ এবং পঞ্চম স্তবকের দিকে ভাল করে তাকালে বোঝা যায়, এই গানের সঙ্গে ব্রিটিশ শাসন বা পঞ্চম জর্জের কোনও সম্পর্ক নেই। চতুর্থ স্তবকে ব্রিটিশ শাসনে ভারতবর্ষ যে অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে তার কথা পরিষ্কার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চতুর্থ স্তবকে পৃথিবীর কবি উল্লেখ করেছিলেন—
পঞ্চম স্তবক আরও পরিষ্কার। রবীন্দ্রনাথ দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন যে, পরাধীনতার এই অন্ধকার কেটে যাবে। স্বাধীনতার আলো ফোটা সময়ের অপেক্ষা। তাই এই ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’র শেষ স্তবকে রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেছিলেন—
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাওয়ার ‘অপরাধে’ অসমে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করার নির্দেশ দানকারী মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা কুযুক্তি দিয়েছেন, গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পরে পূর্ব পাকিস্তান যখন ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়। গানটির প্রথম দশ লাইন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ তার জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করলেও এই গানটি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের ফসল। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন যখন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন যে উত্তাল গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার পুরোভাগে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি রচিত হয় এবং গোটা অবিভক্ত বাংলা জুড়ে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে গানটি পরিণত হয়। অরন্ধন, রাখিবন্ধন, কলকাতায় গণজমায়েত, অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের রাজনৈতিক জমায়েতগুলির শুরুতে এবং শেষে গানটি গাওয়া শুরু হয়। নাগপুর পরিচালিত স্কুলগুলিতে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনে এই গানটির ভূমিকার কথা আছে কি না আমার জানা নেই। তবে স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ের যুক্তিনিষ্ঠ ইতিহাসের পাতায় ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন এবং তার সঙ্গে স্বদেশি আন্দোলন এবং সেই সামগ্রিক আন্দোলনের রণধ্বনি হিসাবে রবিঠাকুরের এই গানের গুরুত্বকে ইতিহাস স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই গণআন্দোলনের ফলে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত রদ হয় ১৯১১ সালে। যদিও ব্রিটিশরা কলকাতা থেকে ভারতবর্ষের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত করে।
আমাদের দেশের কোনও রাষ্ট্রভাষা নেই। ২২টি সরকারি ভাষারই সমমর্যাদা। কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা আছে। ভাষার জন্যে জীবন দেওয়ার ঐতিহ্য এবং উত্তরাধিকার নিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’। কাঁটাতারের ওপারের বাঙালির রাষ্ট্রভাষাই কাঁটাতারের এপারের বাঙালির মাতৃভাষা। তবে এখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, বিদেশি রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার অপরাধে যদি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়, তবে বিজেপির কেষ্টুবিষ্টুরা এ বার বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা, অর্থাৎ বাংলায় কথা বলার অপরাধেও বাঙালির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করবেন কি না!
গত ১১ বছরে ভারতবর্ষের পাঠ্যপুস্তকের একটা মৌলিক পরিবর্তন খুব সংগঠিত ভাবে ঘটানো হচ্ছে। পুরাণকে ইতিহাস বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা থেকে শুরু করে ডারউইনের বিবর্তনবাদ, মেন্ডেলিফের পর্যায় সারণির বাদ পড়ে যাওয়া বিজেপির আমলে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের জার্মানি আর ইটালির এক আশ্চর্য পুনরাভিনয় হচ্ছে আমাদের দেশের শিক্ষাক্ষেত্রের রঙ্গমঞ্চে।
আদ্যোপান্ত বাংলা ও বাঙালির বিরোধী বিজেপির স্বাভাবিক ‘টার্গেট’ অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তবে রবীন্দ্রনাথ একা নন। মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকারের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী ইন্দর সিংহ পারমার দেশের প্রথম আধুনিক মানুষ, সমাজ সংস্কারক, সতীদাহের মতো ঘৃণ্য প্রথা অবলুপ্তির নায়ক রাজা রামমোহন রায়কে ‘ব্রিটিশদের দালাল ও ভুয়ো সমাজ সংস্কারক’ বলে প্রবল চাপের মুখে পড়ে কোনওরকমে ক্ষমা চেয়েছেন। বাংলার মনীষীদের অসম্মান করাটা বিজেপির আসলে ডিএনএ-তে রয়েছে।
বাংলার মানুষ ভুলে যাননি, কী ভাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মিছিল থেকে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তির উপর জান্তব তাণ্ডব চালানো হয়েছিল। কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার প্রকাশ্যেই স্বামী বিবেকানন্দকে ‘কনফিউজ়ড লেফটিস্ট’ বলেছিলেন। জেপি নড্ডা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির জন্মস্থান গুলিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু কী জানেন? শিক্ষাক্ষেত্রে বিজেপির ফ্যাসিস্ট এবং আধিপত্যবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামের বর্শাফলক সেই রবীন্দ্রনাথই।
রবীন্দ্রনাথ এক ক্ষণজন্মা প্রতিভা। ১৮৭৫ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ছোট নাটক দিয়ে তাঁর হাত পাকানো শুরু। এর পিছনে ছিল তাঁর পারিবারিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের চর্চা ও প্রভাব। ১৮৭৭ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় ‘ভানুসিংহের পদাবলী’। সতেরো বছর বয়সে তিনি প্রথম বারের জন্য ইংল্যান্ডে যান। সেই সময়েই পাশ্চাত্যের সাহিত্য, সঙ্গীত এবং নাটকের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। ১৮৭৯-১৮৮০। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন আঠারো বা উনিশ। পৌরাণিক ধারা অবলম্বন করে এবং তার সঙ্গে সামাজিক বোধের সংমিশ্রণে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘বাল্মীকি প্রতিভা’। ঠাকুরবাড়িতে তা অভিনীত হল। ১৮৮২ সালে তাঁর বয়স ২১ বছর। সন্ধ্যা সঙ্গীত (সংস অফ টোয়াইলাইট) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের নামে প্রথম পদ্যের সংকলন। মাত্র একুশেই পৃথিবীর কবি তাঁর সাহিত্যের নাট্যমঞ্চে প্রবেশের ঘোষণা করলেন। এককথায় বলতে গেলে, লোকে যখন স্কুল-কলেজ শেষ করে, সেই সময়ে এই জ্যোতির্ময় বাঙালি ছদ্মনামে কবিতা প্রকাশ করে ফেলেছেন, নাটক লিখে ফেলেছেন, সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরণ করতে শুরু করেছেন। যার ভিত্তিতে পরবর্তী কালে তিনি ‘পৃথিবীর কবি’ হয়ে উঠবেন এবং প্রথম অশ্বেতকায় মানুষ হিসেবে সাহিত্যে নোবেল জিতে নেবেন।
১৮৯০ পারিবারিক জমিদারি দেখাশোনা করার জন্য রবীন্দ্রনাথ গেলেন কুষ্টিয়ায়। বিপুলা পদ্মা রবীন্দ্রনাথকে প্রবল ভাবে আকর্ষণ করল। তাঁর পৃথিবীর কবি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে কুষ্টিয়াতে কুঠিবাড়ির দিনগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে স্কুল পত্তন করলেন রবীন্দ্রনাথ। পরবর্তী কালে এই স্কুল থেকেই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা। যা হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক এবং বৌদ্ধিক শিক্ষার অনন্য কেন্দ্র। ১৯১০ সাল। গীতাঞ্জলি বাংলায় প্রকাশিত হল। ১৯১২ সালে ইংরেজিতে অনুদিত হল। সেই অনুবাদ প্রকাশিত হল লন্ডনে। এবং প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক সাহিত্য দুনিয়ায় ঝড় তুলে দিল। দিকে-দিকে, কোণে-কোণে রবীন্দ্রনাথের পদধ্বনি গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল।
১৯১৩ সালে প্রথম অশ্বেতকায় এবং অ-ইউরোপীয় মানুষ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পেলেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ, তিনিই সাহিত্যের প্রথম নোবেলপ্রাপক, যিনি যে বছর মনোনীত হয়েছিলেন সে বছরই পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার আগে বা পরে কেউ প্রথম বারের মনোনয়নেই সাহিত্যে নোবেল জেতেননি।
১৯১৫ সালে ব্রিটিশ রাজপরিবার তাঁকে ‘নাইটহুড’ সম্মানে ভূষিত করল। যা ছেড়ে দিতে তাঁর এক মুহূর্তও লাগেনি। জালিয়ানওয়ালাবাগের বর্বরোচিত এবং নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পৃথিবীর কবি নাইটহুড ত্যাগ করলেন। সেই মর্মে যে চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন, সেটি এখনও পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য ‘হার্ট রেন্ডারিং লেটার’-এর উদাহরণ হিসাবে। অথচ জালিয়ানওয়ালাবাগ চত্বরে যথাযোগ্য মর্যাদায় কবির কোনও মূর্তি নেই। এই চিঠিটিও যে ভাবে প্রদর্শন করা দরকার, তা-ও জালিয়ানওয়ালাবাগে নেই। বিজেপির আমলে জালিয়ানওয়ালাবাগের যে ‘সংস্কার’ হয়েছে, সেখানে এই চিঠিটিকে কোথায় যেন লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। ভাল করে না-খুঁজলে পাওয়া যায় না।
নাইটহুড ত্যাগ করা সেই সময়ের খুব মামুলি ঘটনা ছিল না। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ট্রিজ়ন এগেনস্ট দ্য এম্পায়ার’। অর্থাৎ, রাষ্ট্রদ্রোহ। ব্রিটিশ মুকুটের বিরুদ্ধে নাইটহুড ত্যাগ করে রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রদ্রোহ করেছিলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি রবীন্দ্রনাথ, তাই ব্রিটিশরা তা নিয়ে খুব জলঘোলা করেনি। যদিও সেই সময়কালেই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছিল, ‘টেগোর আ ম্যান অফ ডিস্টিংটিভ অ্যাপিয়ারেন্স ইজ় আ ট্রু পলিম্যাথ। হি ইজ় অ্যান অ্যাকমপ্লিশড মিউজ়িশিয়ান অ্যান্ড আর্টিস্ট, অ্যান ইলেকট্রিক ফিলোজ়ফার অ্যান্ড অ্যাবাভ অল, আ প্যাশনেট পলিটিকাল অ্যাক্টিভিস্ট। দ্য পোয়েট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাডভোকেট্স ইউনিভার্সালিজ়ম অ্যান্ড কালচারাল ফ্রিডম।’
ইংরেজরা বলেছিল যে, তিনি একজন ‘পলিম্যাথ’। প্রকৃতপক্ষেই তিনি তা-ই। একাধারে কবি, নাট্যকার, সাহিত্যিক, গদ্যকার, চিত্রকর, কম্পোজ়ার, দার্শনিক এবং শিক্ষাবিদ। মনে রাখা দরকার, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তাঁর সম্পর্কে লিখেছিল, ‘সর্বোপরি তিনি একজন উৎসাহী রাজনৈতিক আন্দোলনকারী’।
গোটা জীবনে দু’হাজারের উপর গান লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। আধুনিক ইতিহাসবিদ এবং গবেষকেরা বলেন, ৬০০ শব্দে একটি ছাপানো পাতা হয়। এই ক্ষণজন্মা বাঙালি এমন ১৯ হাজার ছাপানো পাতা লিখেছেন।
১৯২০ পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, চিন-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় গেলেন। ইংল্যান্ডে পৃথিবী বিখ্যাত দার্শনিকদের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন সেই সময়ের গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে এক অন্যতম উল্লেখযোগ্য আদানপ্রদান। এই সময়কালে বিশ্বশান্তি, সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদের প্রতি প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ প্রবল ভাবে সক্রিয় হয়েছিলেন।
ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত তাঁর লেখা। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতও। এমনকি, শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতও রবীন্দ্রনাথের থেকেই উদ্বুদ্ধ। এই রবীন্দ্রনাথের ভাষাকে ‘বাংলাদেশি ভাষা’ বলার দুঃসাহস দেখাতে শুরু করেছেন বিজেপির কিছু কেষ্টুবিষ্টু। বাংলা ভাষায় কথা বলার অপরাধে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কথা বলার অপরাধে অসম থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে মহারাষ্ট্র, মহারাষ্ট্র থেকে মধ্যপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ থেকে ছত্তীসগড়, ছত্তীসগড় থেকে ওড়িশা— সমস্ত বিজেপিশাসিত রাজ্যে বাঙালিদের উপর নির্মম আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। ভাষার জন্য বাঙালি রক্ত দিয়েছে। ৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি দিয়েছে ঢাকায়। শিলচরে দিয়েছে ১৯৬১ সালের ১৯ মে। ভাষার জন্য রক্ত দেওয়ার যে উত্তরাধিকার, সেই উত্তরাধিকার বাঙালির অস্থিতে। বাঙালির মজ্জায়।
জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘একদিন মধ্যাহ্নে খুব মেঘ করিয়াছে। সেই মেঘলা দিনের ছায়াঘন অবকাশের আনন্দে বাড়ির ভিতরের একঘরে খাটের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া একটা স্লেট লইয়া লিখিলাম গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে। লিখিয়া ভারি খুশি হইলাম; তখনই এমন লোককে পড়িয়া শুনাইলাম, বুঝিতে পারিবার আশঙ্কামাত্র যাহাকে স্পর্শ করিতে পারে না। সুতরাং সে গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়িয়া কহিল, বেশ তো, এ তো বেশ হইয়াছে।’ প্রসঙ্গত, ‘গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে’ ভারতী পত্রিকার ১২৮৪তম সংখ্যায় ‘ভানুসিংহের কবিতা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তী কালে কবিতাটিতে সুরসংযোগ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই সমগ্র ঘটনাটি যখন ঘটছে, তখন ১৮৭৭ সাল। রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ষোলো। ঘটনাচক্রে, সেই সময়েই এক পণ্ডিত ব্যক্তিকে রবীন্দ্রনাথ জানালেন, তিনি ব্রাহ্মসমাজের লাইব্রেরি থেকে ভানুসিংহ নামে প্রাচীন কবির লেখা দুষ্প্রাপ্য পুঁথির কিছু কবিতা কপি করে এনেছেন। বলে নিজের সদ্য লেখা কবিতাটি তাকে পড়ে শোনালেন। শুনে পণ্ডিতপ্রবর অত্যন্ত বিচলিত হয়ে বললেন, ‘এ পুঁথি আমার নিতান্তই চাই। এমন কবিতা বিদ্যাপতি চণ্ডীদাসের হাত দিয়াও বাহির হইতে পারিত না।’ তখন রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে লেখা খাতাটি দেখিয়ে গর্বভরে জানালেন, এটি তাঁরই রচনা। শুনে পণ্ডিত গম্ভীর ভাবে বলেছিলেন, ‘নিতান্ত মন্দ হয় নাই।’
রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধ কখনওই ফ্যাসিবাদের মতো দর্শনকে, আধিপত্যবাদকে সমর্থন করেনি। তিনি মানবতার পক্ষে সবসময় অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেছেন। ইটালির ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনি ১৯৩৫ সালে তৎকালীন আবিসিনিয়া (এখন ইথিয়োপিয়া) আক্রমণ করেন। মুসোলিনির আবিসিনিয়ার উপর বর্বরোচিত আক্রমণ কবিকে বিচলিত করেছিল। রবীন্দ্রনাথ তখন অসুস্থ। গোটা ১৯৩৬ সাল তেমন ভাবে কিছু লিখতে পারেননি। ১৯৩৭ সালে মুসোলিনির আবিসিনিয়া আক্রমণের তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল তাঁর জীবনসায়াহ্নের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘আফ্রিকা’ কবিতায়। ১৯৩৮ সালে ‘পত্রপুট’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। যার ষোলো নম্বর কবিতা ছিল ‘আফ্রিকা’। কবির সচিব অমিয় চক্রবর্তী কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। কবিতাটি গোটা দুনিয়া জুড়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিরোধের উচ্চারণ হিসেবে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল। সে দিনের ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে কবির কলম ছিল নির্মম। আজকের ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও সেই রবীন্দ্রনাথই আমাদের প্রধানতম হাতিয়ার।