• কিশোরী মা ভাবছে যৌন নিগ্রহ ‘স্বাভাবিক’, উদ্বিগ্ন পড়শিরা
    এই সময় | ২০ নভেম্বর ২০২৫
  • অন্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায়

    আর মাসখানেকের অপেক্ষা। তার পরেই একটি নতুন প্রাণ জন্ম নেবে বছর পনেরোর মায়ের গর্ভ থেকে। জন্মদাত্রীর ক্ষমতা নেই তার আত্মজা বা আত্মজকে বড় করে তোলার। হয়তো ঠাঁই দেবে না সমাজও। লাগাতার ধর্ষণে এই কিশোরীর এমন দশা। তাই আইন মেনে সদ্যোজাতকে হয়তো দেওয়া হবে দত্তকের জন্যই। সে বেড়ে উঠবে কোনও মা যশোদার কোলে। কী হবে মা দেবকীর। বর্তমানে সরকারি হোমে থাকা ঐশী (নাম পরিবর্তিত) জানে না নিজেও।

    সূত্রের খবর, হুগলির চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি (সিডব্লিউসি)-র নির্দেশে ঐশীর এখন কাউন্সেলিং চলছে। সেখানে সে জানিয়েছে, তার বাবা তাদের সঙ্গে না থাকলেও কখনও-সখনও আসত। বাবা-ই প্রথম তাকে যৌন নিগ্রহ করেছিল। মাকেও সে বহু বার অন্যদের কাছে নিগৃহীত হতে দেখেছে। তাই ওর কাছে এই সব ধর্ষণ-নিগ্রহকে 'স্বাভাবিক' মনে হয়। তাই অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরেও সে বিচলিত হয়নি। ঐশীর এমন ভাবনার কথা জেনে আঁতকে ওঠেন ওর চেনা অনেকেই। কী ভাবে এই পরিণতি ঐশীর। ফেরা যাক বছর ১৫ আগে।

    বিপদে-আপদে এই পরিবারের পাশে থাকা পাড়ারই এক বাসিন্দার কথায়, 'আমরা ঐশীকে জন্মাতে দেখেছি। ওর বাবা ওদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন ও যখন ওর মায়ের পেটে। তখন থেকে ওর মা বাড়ি বাড়ি কাজ ধরেন।' আর এক প্রতিবেশী জানালেন, নাবালিকার মায়ের কিছু মানসিক সমস্যা রয়েছে। সেই সুযোগ নিয়ে তিনিও নিয়মিত যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। পাড়ার আর একজনের কথায়, 'মেয়েটি যাতে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, সে দায়িত্ব আমরাই নিয়েছিলাম।' যাঁর মেয়ের কাছে পড়তে যেত ঐশী, তাঁর কথায়, 'পড়াশোনায় ও বেশ ভালো। হাতের লেখা সুন্দর। পরীক্ষায় রেজাল্টও ভালো করত। তবে ক্লাস সেভেনের পরে আর ওর স্কুলে যাওয়া হয়নি।' স্থানীয় সূত্রে দাবি, এর পর থেকেই সুন্দরী এই কিশোরীর উপরে নজর পরে অনেকের। কখনও খাবারের টোপ, কখনও ড্রেস-কসমেটিক্স কিনে দেওয়ার টোপ ফেলে ওকে যৌন নিগ্রহ করত তারা। যদিও ঐশী কখনও তা নিয়ে কাউকে কিছু বলেনি। পড়শি এক মহিলার কথায়, 'এখন বুঝতে পারছি সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ় নিয়ে ও কেন কিছু কখনও বলত না। তার মানে ওর কাছে তখন থেকেই তা 'স্বাভাবিক।"

    এফআইআর অনুযায়ী, মা-মেয়ের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে একদিন হারু ওরফে সলিলচন্দ্র দত্ত নামে এক ব্যক্তি ঐশীকে কাজের সুযোগ করে দেবে বলে জানায়। রাজিও হয়ে যায় নাবালিকা। কিন্তু হারু তাকে নিয়ে যায় হুগলি ঘাটে সীমা দত্ত নামে এক মহিলার ফ্ল্যাটে। অভিযোগ, সেখানে হারু তাকে লাগাতার ধর্ষণ করত। সীমা তাকে দেহ-ব্যবসাতেও নামায়। এই দুই পাচারকারীর অ্যাকাউন্টে বিপুল অঙ্কের টাকা মিলেছে বলেও সূত্রের খবর।

    চুঁচুড়া মহিলা থানা হারু, সীমা-সহ পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেটের এক অফিসার বলেন, '৬০ দিনের মধ্যেই চার্জশিট দেওয়া হবে। পকসো, মানবপাচার ও বিএনএস-এর একাধিক ধারায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে। প্রত্যেকেই এখন হেফাজতে।'

    এ প্রসঙ্গে সমাজকর্মী অরিজিৎ অধিকারী বলেন, 'পাড়ার মানুষ খুব সজাগ। তাঁদের থেকে আমি জানতে পেরে এফআইআরে সাহায্য করি।' তিনি জানান, ঐশী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ায় ওকে সীমা ওর ডেরায় যেতে নিষেধ করেছিল। তবে অন্য এক মহিলা আসত তার বাড়িতে। যাতে পাড়ার কেউ নাবালিকার প্রেগন্যান্সি সম্পর্কে জানতে না পারে, তাই পাশের একটি জেলায় নার্সিংহোমে তাকে চেক আপের জন্য নিয়ে যাওয়া হতো।

    ঐশী তার ঘনিষ্ঠদের জানায়, ওই মহিলা ৬০ হাজার টাকা দিয়ে সদ্যোজাতকে কিনবেন বলেছিলেন। ওই টাকাটা সংসারের কাজে লাগবে ভেবেই প্রথমে সে রাজি হয়েছিল।

    পুলিশ জানিয়েছে, সেই মহিলা কে ও কোন উদ্দেশ্যে মেয়েটির সন্তানকে কিনতে চেয়েছিল তা দেখা হচ্ছে। এবা অফিসারের কথায়, 'এখানে টট্র্যাফিকিং ও বেবি সেলিং র‍্যাকেট সক্রিয় বলে আমাদের অনুমান।'

    চুঁচুড়া থানা এলাকার বাসিন্দ্য এই মহিলা ও তাঁর সন্তানদের দেখেশুনে রাখেন তাঁদের পাড়ার লোকজনই। তাঁদেরই একজনের কথায়, 'আমরা ঐশীকেই পারলে দত্তক নিতাম। কিন্তু তা তো...।' বাকিদের প্রশ্ন, যে কিশোরী যৌন নিগ্রহকেই 'স্বাভাবিক' মনে করছে, তাকে কী ভাবে ফেরানো হবে আলোর দিশায়?

    সেই উদ্বেগ নিয়েই আজ শিশু অধিকার সুরক্ষা দিবসে তাঁদের অঙ্গীকার ঐশীদের বাঁচাতেই হবে। সমাজের, বাড়ির ও মনের কলুষতা থেকে।

  • Link to this news (এই সময়)