আদ্রার ইরানি কলোনিতে SIR ভীতি! বাসিন্দাদের ভরসা তৎকালীন বার্মার রিফিউজি ক্যাম্পের শংসাপত্র
প্রতিদিন | ২০ নভেম্বর ২০২৫
সুমিত বিশ্বাস, আদ্রা: বছর বছর ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেন। হাতে পেয়েছেন এনুমারেশন ফর্মও। ২০২২ সালের ভোটার তালিকায় অনেকের নামও রয়েছে। তবুও শঙ্কা যেন পিছু ছাড়ছে না। পাছে নাগরিকত্ব খোয়াতে হয়! তাঁদের শিকড় যে ইরানে গাঁথা। তাই ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনের মাঝে দোলাচলে, আশঙ্কায় নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন পুরুলিয়ার রেলশহর আদ্রার ইরানি কলোনির বাসিন্দারা। যাকেই পাশে পাচ্ছেন, এনুমারেশন ফর্ম হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন, “ঠিকমতো পূরণ হয়েছে তো? আমার কিন্তু ২০০২-এর ভোটার তালিকায় নাম নেই। স্বামীর আছে। অসুবিধা হবে না তো?” এখন তাঁদের একমাত্র ভরসা ১৯৩৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বার্মার রিফিউজি ক্যাম্পের শংসাপত্র। সেই সঙ্গে ১৯৮৬ সালের ২ সেপ্টেম্বরের প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের একটি চিঠি।
সালটা ১৯৩৩। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালেরও আগের কথা। আফগানিস্তান থেকে বার্মা। সেখানে দীর্ঘদিন রিফিউজি ক্যাম্পে থাকা। বলা যায়, তাঁদের আটকে রাখা হয়েছিল। তারপর মুম্বই থেকে ওড়িশা। সেখান থেকে ঝাড়খণ্ডের জামশেদপুর হয়ে কেউ রেলশহর আদ্রা, আবার কেউ দুর্গাপুরে বসতি স্থাপন করেছেন। কেউ আবার দুর্গাপুর হয়ে আদ্রা। আর কেউ আদ্রা, দুর্গাপুর থেকে মেদিনীপুর ও মুর্শিদাবাদ। ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে ইরান থেকে তাঁরা ভারতে চলে আসেন। তাঁদের ভাষা পার্সি। ইরানি বংশোদ্ভুত এই গোষ্ঠী বাংলা-সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন তখন থেকেই। সেসময় তো ভারত, পাকিস্তান, বার্মা সব এক। ১৯৩৫ সালে ভারত থেকে বার্মার বিচ্ছিন্নতা। তার আগে বার্মা ভারতের একটি প্রদেশ হিসেবে শাসিত হতো।
তাই রেলশহর আদ্রার ইরানি কলোনির বাসিন্দা শালু আলির হাতে রয়েছে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া বংশানুক্রমে বার্মার রিফিউজি ক্যাম্পের শংসাপত্র। যে শংসাপত্র কার্যত একপ্রকার ট্রেড লাইসেন্স। বেশকিছু ইংরাজি অক্ষর মুছে যাওয়া ওই শংসাপত্র আওড়ালে বোঝা যায় পার্সিদের
ভারতে ব্যবসা করার যেন ছাড়পত্র। আর এই শংসাপত্র হাতে নিয়েই ৫৪ বছরের শালু আলির আত্মবিশ্বাসে ভরা কন্ঠ, “আমি ভারতীয়। আমাদের গোড়া ইরান হলেও আমরা ভারতবাসী।”
রেলশহর আদ্রার ডিভিসি কলোনির কাঁটারাঙ্গুনি জুনিয়র হাই স্কুলের পাশে একটি কলোনি গড়ে প্রায় ১০ টি ইরানি পরিবারের বসবাস। সেখানেই রয়েছে ইমামবাড়া। ইরানে বিশ্ববিখ্যাত কার্পেট ব্যবসার চল থাকলেও কলোনির অধিকাংশ বাসিন্দাই রত্ন-পাথরের ব্যবসা করেন। ওই কলোনিতে শালু আলির সঙ্গে তাঁদের উৎস নিয়ে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে চলে আসেন সেখানকার বাসিন্দা, মুর্শিদাবাদ থেকে বিয়ে হয়ে আসা পারভিন বেগম নামে এক মহিলা। এনুমারেশন ফর্ম হাতে নিয়ে দেখাতে থাকেন, ঠিকঠাক পূরণ হয়েছে কিনা। তার যে ২০০২-এর ভোটার তালিকায় নাম নেই। আর তখনই শালু আলি বলেন, “হামারা কলোনি মে ইয়ে লেড়কি সবসে ডরা হুয়া হে!”
শুধু পারভিন নন আরও দু’জন তরুনী ওই এনুমারেশন ফর্ম নিয়ে বলেন, “দেখিয়ে দেখিয়ে সব ঠিক হ্যায় না? হাম ইহা পেঁ রেহে সেকেঙ্গে তো?” এই কলোনিতেই থাকেন ৭০ বছরের নার্গিস বিবি। তাঁর স্বামী মারা গিয়েছেন অনেকদিন। ছেলেমেয়ে কেউ নেই। কয়েক বছর আগে পড়ে গিয়ে তিনি মারাত্মক জখম হন। ভারী শরীর নিয়ে এখন কুঁজো হয়ে হাঁটেন। বছর দুই আগে তাঁর ঘর আগুনে পুড়ে যায়। ভোটার ও আধার কার্ড বোনের কাছে থাকায় তা রক্ষা পায়। এছাড়া সব নথি পুড়ে গিয়েছে। এই এসআইআরের সময় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তিনি। ২০০২ সালে ভোটার তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও।
তবে অভয় দিচ্ছেন তাঁর ভাই শালু আলি। তাঁর ও স্ত্রীর ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে। তবুও তিনি তাঁর দুর্গাপুরের সেন্ট মাইকেল স্কুল থেকে টিসি আনতে মরিয়া। তাঁর কথায়, “আমি ওই স্কুলে আবেদন করে এসেছি আমার টিসির জন্য। ১৯৮৪-৮৫ সালে ওই স্কুলে আমি নবম শ্রেণিতে লেখাপড়ার পর ছেড়ে দিই। ফলে ওই নথি আমার কাজে লাগবে। কারণ, নির্বাচন কমিশন বলেছে ১৯৮৭ সালের আগের নথির মান্যতা মিলবে। এটা শুধু আমার জন্য নয়। ভবিষ্যতে আমার ছেলেমেয়েদের জন্য ওই নথি আমি স্কুল থেকে নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখতে চাই। আশা করছি কিছুদিনের মধ্যে পেয়ে যাব। স্কুল কর্তৃপক্ষ বলেছে একটু সময় লাগবে। অনেক পুরনো তো।”
এদিকে শালু আলির ছেলে তাঁর ঠাকুরদা আসিক আলির একটি চিঠি নিয়ে ব্যস্ত। ১৯৮৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে কোনও চিঠির প্রাপ্তিতে আসিক আলিকে জানানো। যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিদেশ মন্ত্রককে লেখা। বাবার রত্ন ব্যবসায় সাহায্য করা সইফ বলছিলেন, “আমাদের মূল নথি বার্মার রিফিউজি ক্যাম্পের শংসাপত্র যেমন রয়েছে তেমনই পাশাপাশি আরও নানান নথি আমরা প্রস্তুত করে রাখছি। যাতে কোনও সমস্যা না হয়। “
১৯৪২ সাল নাগাদ বার্মার রিফিউজি ক্যাম্প থেকে শালু আলির ঠাকুরদা আলম বেগ প্রথম মুম্বাইয়ে পা রাখেন। তারই তৃতীয় সন্তান আশিক আলি। যিনি ১৯৮৮তে মারা যান। ঝাড়খন্ডের জামশেদপুরে তাকে কবর দেওয়া হয়। তারপর তার ছেলে শালু আলি ২০০১ সাল নাগাদ আদ্রার ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রাউন্ডের কাছে তাঁবু করে থাকেন। সেখান থেকেই আদ্রার পির আনসারি, ইনসাফ আনসারিদের কাছ এক বিঘা জমি কেনেন। সেই সময় ৫ হাজার টাকা ডেসিমেল হলেও সব টাকা দিতে পারেননি। ব্যবসা করে ধীরে ধীরে শোধ করেন। সেই সময়ই এই কলোনিতে গড়ে ওঠে ইমামবাড়া। চেয়ার ছেড়ে শালু আলি বলে ওঠেন, “অব হাম উড়তে উয়ে পনছি নেহি!
ইয়ে ভারতই হামারা ঘর হে। হামারা পহেচান হে!”