এই সময়: বুধবার সকাল সাড়ে ৯টা–১০টার ঘটনা। বরদান মার্কেটের সামনে একটি প্রাইভেট গাড়ি বাঁ দিকে বাঁক নেওয়ার সময়ে একটি মোটরবাইক নিয়ম ভেঙে বাঁ দিক দিয়েই ওভারটেক করার চেষ্টা করে গাড়িটিকে। শেষ মুহূর্তে গাড়িচালক ব্রেক কষলেও বাইকটি গাড়িকে ধাক্কা মেরে উল্টে যায়। গাড়িচালক হঠাৎ ব্রেক কষায় গাড়ির যাত্রীর মাথা ঠুকে যায় সিটে। আর বাইক চালক রাস্তায় পড়ে সামান্য জখম হন, ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাইকটি।
তার পরের ঘটনাক্রম এ রকম— গাড়িচালক বেরিয়ে এসে বাইক চালককে তুলে ধরাধরি করে বাইকটি খাড়া করার চেষ্টা করতে উল্টে বাইক চালকই তাঁর সঙ্গে অভব্য আচরণ করেন, যেন দোষটা তাঁরই। বাইক চালকের দাবি, ভুল ছিল গাড়িরই। কর্তব্যরত ট্র্যাফিক সার্জেন্টকে গাড়িচালক গোটা বিষয়টি জানিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ দেখার অনুরোধ করলেও সার্জেন্টের জবাব, ‘এখন ফুটেজ দেখার সময় নেই। আপনারা কথা বলে বিষয়টি মিটিয়ে নিন। না হলে থানায় যান।’ শেষমেশ থানায় পুলিশের মধ্যস্থতায় বাইক চালকের ‘ক্ষতি’র জন্য গাড়িচালক হাজার তিনেক টাকা দিয়ে তবে ‘মিটমাট’ হয়।
এটা কোনও বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। প্রায় প্রতিদিনই শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে মোটরবাইক চালকদের একাংশ এ ভাবে নিয়ম ভেঙে বাইক চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছেন। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই সেই দুর্ঘটনার জন্য প্রাথমিক ভাবে দায়ী ধরা হচ্ছে তুলনায় বড় গাড়িটিকে। তা নিয়ে গাড়িচালক বা আরোহীকে হেনস্থার মুখে পড়তে হচ্ছে। আবার পুলিশও প্রাথমিক ভাবে সংশ্লিষ্ট বাইক চালকের অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রুজু করছে সংশ্লিষ্ট গাড়িচালকের বিরুদ্ধে।
শহরের বিভিন্ন প্রান্তের ট্র্যাফিক সার্জেন্টদের বক্তব্য, অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাইক আরোহীর জন্য দুর্ঘটনা ঘটছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের জন্য মামলাও রুজু করা হচ্ছে তাঁদের বিরুদ্ধে। প্রচার চলছে, কিন্তু তার পরেও হুঁশ ফিরছে না এক শ্রেণির বাইক চালকের। কলকাতা পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত শহরে সব ধরনের যানবাহন মিলিয়ে গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে ৪১.২৮ শতাংশ। আর মধ্যে শুধু বাইক–স্কুটার সমেত টু–হুইলারের সংখ্যা বেড়েছে ৫৩.৮ শতাংশ। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে টু–হুইলারের নিয়ম ভাঙার প্রবণতাও। পুলিশের তথ্য বলছে, ২০২৪–এ শহরে সবক’টি পথ দুর্ঘটনা মিলিয়ে যে ১,৯১৫ জন হতাহত হয়েছেন, তার অন্তত ২৩ শতাংশ ক্ষেত্রে দায়ী টু–হুইলার। ওই বছরে বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি মামলাও রুজু হয়েছে টু–হুইলারের বিরুদ্ধেই। সংখ্যাটা ২৩,০৮৭, যা অন্যান্য সব ধরনের গাড়ির সম্মিলিত কেসের প্রায় সমান।
তাতেও বাইক চালকদের একাংশের এই প্রবণতা কেন ঠেকানো যাচ্ছে না? কেনই বা এই ধরনের দুর্ঘটনার পরে সঙ্গে সঙ্গে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে সেই মতো মামলা রুজু করা হচ্ছে না বাইক চালকের বিরুদ্ধে? কেনই বা দুর্ঘটনা ঘটলেই ‘দায়’ বড় গাড়ির ধরে নিয়ে ঘটনার ‘মিটমাট’ হবে?
লালবাজারের ট্র্যাফিক বিভাগের এক কর্তা মানছেন, ‘কোনও দুর্ঘটনায় বড় গাড়ির ক্ষেত্রেই মামলা হবে, ছোট গাড়ির বিরুদ্ধে নয়, এমনটা ভারতীয় ন্যায় সংহিতা বা মোটর ভেহিকেলস অ্যাক্টে কোথাও নেই।’ তা হলে? ওই পুলিশকর্তার ব্যাখ্যা, ‘এ রকম কোনও দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যুক্ত দুই গাড়ির চালকই মামলা দায়ের করতে পারেন। পুলিশ সেই অনুযায়ী তদন্ত করবে এবং সংশ্লিষ্ট গাড়ি প্রয়োজনে সিজ় করবে। তারপরে সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে প্রসিকিউট করা হবে।’ সঙ্গে সঙ্গে ফুটেজ দেখলেই তো সমস্যা দ্রুত মিটে যেতে পারে! এ ক্ষেত্রে অবশ্য পুলিশের যুক্তি, ‘অনেক সময়ে দেখা যায়, ছোটখাটো দুর্ঘটনার পরে সঙ্গে সঙ্গে আইন–শৃঙ্খলা জনিত সমস্যা তৈরি হয়। সেটা মেটাতেই পুলিশকে ব্যস্ত থাকতে হয় এবং দুই গাড়ি ও চালক–মালিককে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। গোলমাল মিটলে দু’পক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করে পুলিশ। আবার অনেক সময়ে গোলমাল না–হলেও সেই মুহূর্তে দু’টি গাড়িকেই থানায় পাঠিয়ে দ্রুত ট্যাফিক স্বাভাবিক করার কাজে জোর দিতে হয়।’ তবে পুলিশের ব্যাখ্যা, বাইক বা বড় গাড়ির বিষয় নয়, যদি দু’পক্ষই মামলা করতে চান, তা হলে সেই অনুযায়ী দু’টি অভিযোগ নিয়েই তদন্ত করতে হবে। অনেক সময়ে পরবর্তী আইনি জটিলতা এড়াতেও গাড়ির মালিকরা লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে চান না।
এক ট্র্যাফিক সার্জেন্টের অবশ্য ব্যাখ্যা, কোনও ছোটখাটো দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশ যদি প্রাথমিক ভাবে দেখে, তুলনায় ছোট গাড়ির ধাক্কায় বড় গাড়ির ক্ষতি হতে পারে তবে গাড়ির আরোহীর মৃত্যু বা গুরুতর আঘাতের সম্ভাবনা কম, তা হলে বিষয়টাকে মানবিক ভাবেও বিবেচনা করা হয়। তবে তার ফাঁক গলেই যে টু–হুইলার চালকদের একাংশের বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের জেরে ছোট–বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, সেটাও মানছেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করার মতো পুলিশের সংখ্যাও নেই বলে জানাচ্ছেন তিনি।