• এসআইআর: কোন নথির ভিত্তিতে কাটবে জট, তালিকায় উঠবে নাম
    আজকাল | ২১ নভেম্বর ২০২৫
  • গোপাল সাহা

    ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (স্পেশাল ইন্টেন্সিভ রিভিশন বা এসআইআর) প্রক্রিয়া নভেম্বরের ৪ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। আর তা নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোর ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে, রাজ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যেও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। এর বহু মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে। কিছু সংখ্যক ব্যক্তিরা আত্মঘাতী হয়েছেন, আবার কারও মানসিক চাপের কারণে হৃদরোগে মৃত্যু হয়েছে। এই সকল মৃত্যুর জন্য দায়ী এসআইআর, এমনটাই অভিযোগ তৃণমূলের। এই অভিযোগের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিজেপিও। 

    ২০০২ সালে এসআইআর প্রক্রিয়ায় কতজনের নাম বাদ পড়েছিল?

    ২০০২ সালে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের (ইসিআই) নির্দেশ অনুযায়ী প্রথম এসআইআর প্রক্রিয়া হয়। তৎকালীন কেন্দ্রে বিজেপি সরকার। প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। আর সেই সময় বাংলার শাসক দল সিপিআইএম তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সদ্য জয়ী হয়ে বাংলার মসনদে। আর সেই বছর বাংলায় এস আই আর হওয়ার কারণে ভোটার তালিকা থেকে বাদ যায় প্রায় ২৫ লক্ষ নাম। এরপর ২৩ বছর অতিক্রম করে ২০২৫-এ আবারও শুরু হয়েছে এসআইআর। 

    SIR নিয়ে রাজ্যে শাসক-বিরোধী তরজা! বার্তা মমতার

    পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সুরক্ষা নিয়ে রাজ্যের প্রশাসন যেমন উদ্বিগ্ন, তেমনই একই ভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। অন্যদিকে, বিরোধী দলের বক্তব্য, অন্যান্য রাজ্যে এসআইআর চলছে (পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া আরও ১১টি রাজ্যে এসআইআর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে), কিন্তু সে সমস্ত রাজ্যে কোনও উত্তেজনা বা উদ্বেগ বা মানুষের প্রাণ যায়নি। শুধু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেই যত সমস্যা। 

    বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি মুখ্য নির্বাচ কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারকে চিঠি দিয়ে অবিলম্বে SIR প্রক্রিয়া বন্ধ করার আবেদন জানান। মমতা চিঠিতে বলেন, “বিষয়টি উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে। সাধারণ মানুষের ওপরে এসআইআর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিএলও-দের পর্যাপ্ত পরিমাণে শিক্ষা পর্যন্ত প্রদান করা হয়নি হটকারিতার কারণে। গোটা প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আপনি হস্তক্ষেপ করুন এবং এই প্রক্রিয়া অবিলম্বে স্থগিত করুন, না হলে জনতা থেকে অফিসার সবার ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।” 

    অন্যদিকে, কমিশন দাবি করেছে, পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর মসৃণভাবে চলছে। 

    কত এনুমারেশন ফর্ম বিলি হল রাজ্যে?

    নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত দু’দিনে  এসাআইআর প্রক্রিয়ার কাজ যথেষ্ট বিলম্বিত হয়েছে। গত বুধবার পর্যন্ত ফর্ম বিতরণ সম্পন্ন হয়েছিল ৯৯.৭২ শতাংশ। কিন্তু শুক্রবার পর্যন্ত তা ৯৯.৭৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যা ৭ কোটি ৬৬ লক্ষের মধ্যে ৭,৬৪,৩৫,২৩৬ কোটি ফর্ম বিলি করা হয়েছে। আর অনলাইন বা ডিজিটাল ফর্ম বিতরণ ২ কোটি ৪৫ লক্ষ ৩১ হাজার ৫৭। শতাংশের ভিত্তিতে ৩২.০১ শতাংশ।

    SIR প্রক্রিয়া ও এনুমারেশন ফর্ম নিয়ে একাধিক নিয়মাবলী ও নির্দেশিকা:

    কমিশন এনুমারেশন ফর্ম ফিলাপ ও নাম নথিভুক্তের জন্য যে সময়সীমা বেধে দিয়েছে তার মধ্যে প্রথম পর্যায়ের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হতে হবে। এরপর ৯ ডিসেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত এই এক মাস সময়সীমার মধ্যে যাদের নাম প্রথম তালিকায় উঠবে না, তাদের কমিশনের কাছে আবেদন জানানোর সময় থাকবে। প্রথম তালিকা প্রকাশিত হবে ৪ থেকে ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে। যাঁদের নাম প্রথম তালিকায় থাকবে না বা কোনও গরমিল থাকবে তাঁদের ইআরও  নোটিশের মাধ্যমে ডাক পাঠাবে। তাঁরা আবেদন জানাবেন বিএলও-র  কাছে। কমিশনের দেওয়া একটি ফর্ম ফিলাপের মাধ্যমে সেই আবেদন জানাতে হবে এবং তাদের ডাক এলে ইলেক্টোরাল রিটার্নিং অফিসার বা ইআরও-র কাছে প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে হবে। সঠিক নথি জমা দিতে পারলেই ভোটার তালিকায় তাদের নাম নথিভুক্ত হবে এবং চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হবে ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ। ফলে ভোটার তালিকায় নাম নথিভুক্ত নিয়ে কোন আতঙ্ক বা ভয়ের বিষয়ে কিছুই নেই বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন। কমিশন পূর্বেই জানিয়েছিল, কোন অবস্থাতেই যোগ্য ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ যাবে না।

    কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের রাজ্য পরিদর্শন

    নির্বাচন কমিশনের একটি বিশেষ টিম, যার নেতৃত্বে রয়েছেন অতিরিক্ত জাতীয় নির্বাচন কমিশন জ্ঞানেশ ভারতী। তারা রাজ্যের বিভিন্ন জেলাগুলিতে এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে খতিয়ে দেখতে এবং  রিভিশনের জন্য কাজ শুরু করেছেন এবং সঙ্গে রয়েছেন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক মনোজ আগরওয়াল। ১৮ তারিখ পশ্চিমবঙ্গে এসে প্রথমে বুধবার মুর্শিদাবাদ এবং বৃহস্পতিবার মালদা জেলা পরিদর্শন করে রাতে ফিরেছেন। এরপরই নির্বাচন কমিশন সমাজমাধ্যমে টুইট করে জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া চলছে যথেষ্ট শান্তিপূর্ণ ভাবে। দক্ষিণবঙ্গে এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে যে সকল অভিযোগ উঠেছে তা খতিয়ে দেখবে কমিশনের দল। সূত্রের খবর, শুক্রবার নিউটাউনে কমিশনের বিশেষ দল একটি বৈঠক করে। সেখানে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ইভিএম। এছাড়াও রাজ্যে সুষ্ঠভাবে এসআইআর প্রক্রিয়া চালানো নিয়েও আলোচনা হয়।

    প্রথম পর্বে ভোটার তালিকায় নাম না থাকলে কী করনীয়

    প্রথম তালিকায় যাদের নাম থাকবে না তাদের জন্য ১১টি নথির তালিকা দিয়েছে কমিশন। যার মধ্যে একটি নথি দিতে পারলেই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

    এছাড়াও, আবেদনকারীরা পূর্ববর্তী SIR ইলেক্টোরাল রোল-এ নিজেদের নাম এবং সংশ্লিষ্ট আত্মীয়/পরিজনের নাম যাচাই করতে পারেন https://voters.eci.gov.in/ এই ওয়েবসাইটে, এবং সেই অনুযায়ী ঘোষণা-পত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করতে পারবেন।সহায়তার জন্য আবেদনকারীরা সংশ্লিষ্ট BLO-র সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

    দেখে নেওয়া যাক  সেই ১১টি কী কী প্রয়োজনীয় নথি-

    যেসব আবেদনকারীর ঘোষণা-পত্রে প্রদান করা পূর্ববর্তী SIR ইলেক্টোরাল রোলের তথ্য পাওয়া যায় না বা ডেটাবেসের সঙ্গে মেলে না, তাদের ERO নোটিস ইস্যু করবে। নোটিস পাওয়া গেলে আবেদনকারীকে নিম্নোক্ত শ্রেণিবিভাগ অনুসারে প্রয়োজনীয় নথি জমা দিতে হবে:

    ১) ০১.০৭.১৯৮৭-এর আগে ভারতে জন্মগ্রহণ করলে

    নিজের জন্মতারিখ এবং/অথবা জন্মস্থান প্রমাণকারী নিচের তালিকাভুক্ত নথিগুলোর যে কোনও একটি জমা দিতে হবে।

    ২) ০১.০৭.১৯৮৭ থেকে ০২.১২.২০০৪-এর মধ্যে ভারতে জন্মগ্রহণ করলে

    নিজের জন্মতারিখ এবং/অথবা জন্মস্থান প্রমাণকারী যে কোনও একটি নথি জমা দিতে হবে।

    পিতা বা মাতার জন্মতারিখ এবং/অথবা জন্মস্থান প্রমাণকারী নিচের তালিকাভুক্ত নথিগুলোর যে কোনও একটি জমা দিতে হবে।

    ৩) ০২.১২.২০০৪-এর পরে ভারতে জন্মগ্রহণ করলে

    নিজের জন্মতারিখ এবং/অথবা জন্মস্থান প্রমাণকারী যে কোনও একটি নথি জমা দিতে হবে।

    পিতার জন্মতারিখ এবং/অথবা জন্মস্থান প্রমাণকারী যে কোনও একটি নথি জমা দিতে হবে।

    মাতার জন্মতারিখ এবং/অথবা জন্মস্থান প্রমাণকারী যেকোনো একটি নথি জমা দিতে হবে।

    যদি কোনও পিতা বা মাতা ভারতীয় না হন, তাহলে আবেদনকারীর জন্মের সময় তাদের বৈধ পাসপোর্ট ও ভিসার কপি জমা দিতে হবে।

    ৪) ভারতের বাইরে জন্মগ্রহণ করলে

    বিদেশে ভারতীয় মিশন কর্তৃক প্রদত্ত জন্ম শংসাপত্রের কপি জমা দিতে হবে।

    ৫) নিবন্ধন/স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকত্ব অর্জন করলে- নাগরিকত্ব শংসাপত্র সংযুক্ত করতে হবে।

    নথির তালিকা

    1. কেন্দ্রীয়/রাজ্য সরকার/PSU-র নিয়মিত কর্মচারী বা পেনশনারদের জন্য ইস্যুকৃত যেকোনো পরিচয়পত্র/পেনশন পেমেন্ট অর্ডার।

    2. ০১.০৭.১৯৮৭-এর আগে ভারতে সরকার/স্থানীয় প্রশাসন/ব্যাঙ্ক/ডাকঘর/LIC/PSU কর্তৃক ইস্যু করা যে কোনও পরিচয়পত্র/শংসাপত্র/নথি।

    3. যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইস্যু করা জন্ম শংসাপত্র বা নথি।

    4. পাসপোর্ট।

    5. স্বীকৃত বোর্ড/বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ইস্যুকৃত ম্যাট্রিকুলেশন/শিক্ষাগত নথি।

    6. রাজ্য প্রশাসনের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইস্যু করা স্থায়ী বাসিন্দা শংসাপত্রষ

    7. ফরেস্ট রাইটস শংসাপত্র।

    8. যোগ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইস্যু করা OBC/SC/ST বা যে কোনও জাতি শংসাপত্র

    9. ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স (যেখানে প্রযোজ্য)।

    10. রাষ্ট্র/স্থানীয় প্রশাসনের দেওয়া পরিবার রেজিস্টার।

    11. সরকার কর্তৃক ইস্যু করা যে কোনও জমি/বাড়ি বরাদ্দ-সংক্রান্ত নথি।

    12. সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আধার কার্ডকে পরচিয়পত্র হিসেবে দাখিল করা যেতে পারে।

    পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর প্রক্রিয়া আগামীতে কতটা সুষ্ঠুভাবে হয় এবং চূড়ান্ত তালিকা ঘোষণায় কী হয় সেদিকেই নজর সমস্ত রাজ্যবাসীর।
  • Link to this news (আজকাল)