পুরুলিয়া থেকে রায়গঞ্জ, মৌমাছির আক্রমণে একের পর এক মৃত্যু! বাড়ছে আতঙ্ক
প্রতিদিন | ২১ নভেম্বর ২০২৫
গৌতম ব্রহ্ম: পুরুলিয়ার (Purulia) কাশীপুর থানার সিমলা গ্রামে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে লেলহে মাছির (এক ধরনের বড় মৌমাছি) আক্রমণে ৬৮ বছর বয়সি অবসরপ্রাপ্ত আয়কর কর্মচারী শীতল মিশ্র মারা যান। দুর্গাপুরের মেজর পার্কের কাছে একটি মৌমাছির চাক ভেঙে যাওয়ায় ৬২ বছর বয়সি অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নির্মল দত্তর মৃত্যু হয়। তিনি সম্ভবত মৌচাক ভাঙার সময় আক্রান্ত হয়েছিলেন। চিকিৎসকদের মতে, তাঁর শরীরে প্রায় ৮৫০টি মৌমাছির হুল পাওয়া গিয়েছিল।
সম্প্রতি রায়গঞ্জে একমাসের মধ্যে মৌমাছির কামড়ে দু’টি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। একটি ক্ষেত্রে গরুর শিংয়ের আঘাতে রাস্তার ধারে একটি বাঁশের বেড়ার গায়ে থাকা ভীমরুলের চাক ভেঙে কয়েকশো ভীমরুলের কামড়ে মৃত্যু হয় এক ব্যক্তির। অন্য একটি ঘটনায় বাজপাখির ঠোঁটের ঘায়ে মৌমাছির চাক ভেঙে যাওয়ায় কয়েকশো মৌমাছির কামড়ে এক প্রাতঃভ্রমণকারী মারা যান।
আসানসোলের জামুড়িয়া থানার চুরুলিয়ার বাসিন্দা খাড়ু রুইদাস বাড়ির পাশে একটি গাছ থেকে মৌচাক ভেঙে মধু সংগ্রহ করছিলেন। সে সময় একঝাঁক মৌমাছি তাঁকে হুল ফোঁটায়। আসানসোল জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃতৃ হয় তাঁর। খুঁজলে এমন ঘটনা আরও পাওয়া যাবে। বিশেষ করে সুন্দরবন অঞ্চলে মধু সংগ্রহের সময় মৌমাছির কামড়ে অনেক সময়ই প্রাণ সংশয় হয়। কিন্তু, সব ঘটনা খবরে আসে না। তাই ডকুমেন্টেড হয় না। কিন্তু, এটা ঘটনা যে অতি মাত্রায় হুল ফুঁটিয়ে মৌমাছি, বোলতা, ভীমরুল প্রাণ কাড়তে পারে। তবে পুরুলিয়া কিংবা দুর্গাপুরের ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কারণ দু’টি ক্ষেত্রেই মৃত ব্যক্তিরা কেউই মৌমাছিকে আক্রমণ করতে যাননি।
পুরুলিয়ার শীতল মিশ্র প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। আর দুর্গাপুরের নির্মল দত্ত রাস্তায় পড়ে থাকা এক পথচারীকে স্কুটার থামিয়ে বাঁচাতে নেমেছিলেন। এই ঘটনায় দু’টি এলাকাতেই আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। রাস্তায় বেরোতেও অনেক ভয় পাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে চিকিসকরাও সতর্ক করেছেন মৌমাছি নিয়ে। বাঁকুড়া মেডিক্যালের অধ্যাপক তথা বিষ বিশেষজ্ঞ ডা. সোমনাথ দাস জানিয়েছেন, একজন মানুষকে প্রচুর মৌমাছি দংশন করলে মৃত্যু হতে পারে। হুলে থাকা বিষ শরীরে ঢুকলে অ্যানাফাইলেক্টিক শক তৈরি হতে পারে। অ্যান্টিবডি, অ্যান্টিজেনের মারামারিতে শরীরে প্রদাহ হয়। হিস্টামিন, ফেরোটোনিনের মতো কিছু রাসায়নিক নিঃসৃত হয় দংশনস্থল থেকে। যা রক্তে মিশে টাইপ ওয়ান হাইপার সেনসিটিভিটি রিঅ্যাকশন তৈরি করে। ইডিমা তৈরি হয়। জল জমতে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায়। শ্বাসনালিও এই ইডিমার কারণে ফুলতে শুরু করে। রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। একটা সময় চোকড হয়ে যায় রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট। এই সময় রোগীকে ইনটিউবেট না করলে ও অ্যান্টি হিস্টামিন বা অ্যাড্রিনালিন গোত্রের ওষুধ না দিলে বিপদ।
সোমনাথবাবু জানালেন, তিনি নিজে মৌমাছির কামড়ে মৃত দুই রোগীর ময়নাতদন্ত করেছেন। তবে একটি-দু’টি মৌমাছির কামড়ে জ্বালাযন্ত্রণা ছাড়া কিছু হয় না। ঝাঁকে ঝাঁকে দংশনেই হয় সমস্যা। শীতলবাবুর ক্ষেত্রেও শরীরের কোথাও বাদ ছিল না। দুর্গাপুরের নির্মলবাবুর শরীরে অন্তত ৮৫০ মৌমাছির হুল পাওয়া গিয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। পতঙ্গবিদ অর্ণব চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ভারতে মূলত ছয় প্রজাতির মৌমাছি পাওয়া যায়, যারা এপিস গোত্রভুক্ত। এপিস ডোরাস্টা, এপিস ল্যাবোরিওসা, এপিস অ্যাড্রিনোফর্মিস, এপিস ফ্লোরিয়া, এপিস মেলিফেরা, এপিস সেরানা ইন্ডিকা। এর মধ্যে এপিস সেরেনা ও এপিস মেলিফেরা মধু চাষের জন্য ব্যবহার করা হয়। এরা নিরীহ প্রকৃতির। তবে এপিস ডোরাস্টা খুব আক্রমণাত্মক। এদের বাসায় আঘাত করলে একসঙ্গে কমপক্ষে ৫০টি মৌমাছি আঘাত হানতে পারে। এদের হুল খুব যন্ত্রণাদায়ক। পরিযায়ী প্রকৃতির এই মৌমাছির ঝঁাকে কয়েক হাজার সদস্য থাকে। এরা হিমালয় থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত ‘মাইগ্রেট’ করতে পারে।