২০১৬ পর্যন্ত কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির পাটুলির কাছে বাইপাসের ধারে প্রায় নোংরা জলের ডোবা হয়েই পড়েছিল জায়গাটা। তখন বাইপাসের সম্প্রসারণের জন্য হকার উচ্ছেদ ও তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। এমন সময় ওই ডোবাই নজরে পড়ে সরকারের। তার আগে সরকারের এক মন্ত্রী বেড়াতে গিয়েছিলেন পাটায়ায়। সেখানকার ভাসমান বাজারের আদলে তৈরি করার পরিকল্পনা হয় পাটুলি বাজার— সেখানেই পুনর্বাসন হবে হকারদের।
আত্মপ্রকাশ করল কলকাতার নতুন টুরিস্ট স্পট। স্থানীয় মানুষও এই বাজার থেকে কেনাকাটা শুরু করলেন। বাজারটি কিছু বছর দিব্য চলল। তার পর, ভেসে গেল আদরের নৌকা। দাম বেশি থেকে মশার কামড়, অভিযোগের পাহাড়ে ভরে গেল ভাসমান বাজার। ধীরে ধীরে থিতিয়ে পড়ল ক্রেতার সংখ্যাও। তার পরে কোভিড-পরবর্তী সময়ে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি ভাসমান বাজার।
পাটায়ার ফ্লোটিং মার্কেট এবং সিঙ্গাপুরের জলভিত্তিক নগর পরিকল্পনা, দুইয়েরই লক্ষ্য ও প্রেক্ষাপট আলাদা। পাটায়ার বাজার মূলত নদী ও খালের সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন জীবিকায় গেঁথে আছে। নৌকা চলাচল, স্থানীয় খাদ্য ও হস্তশিল্পের সরবরাহ-সহ এটি পর্যটক আকর্ষণের এক স্বাভাবিক কেন্দ্র। অন্য দিকে, সিঙ্গাপুর শহরের জলসম্পদকে নিয়ন্ত্রিত ভাবে বাণিজ্য ও বিনোদনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। কলকাতার পাটুলি ফ্লোটিং মার্কেট এই দুই ধারার মিশ্রণ— তাইল্যান্ডের নকশা অনুকরণ করা হয়েছে, সিঙ্গাপুরের মতো স্থির ও নগরকেন্দ্রিক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় জীবিকা বা নৌকা চলাচলের সঙ্গে তার বাস্তব সম্পর্ক কম।
১০ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল এই বাজার তৈরি করতে। ২০০টির বেশি নৌকা করা হয়েছিল। প্রতিটি নৌকায় দুটো করে দোকান ছিল। এখন সবটাই বন্ধ। তবে আশার আলো, এই বাজার সংস্কার নিয়ে ইতিমধ্যেই ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে।
বিদেশি কায়দায় শহরকে সাজিয়ে তোলার অন্যতম হাতিয়ার ছিল ত্রিফলা আলো। ২০১২ সালে কলকাতায় প্রায় ১২,০০০ ত্রিফলা বাতিস্তম্ভ বসিয়েছিল পুরসভা। খরচ হয়েছিল ২৭ কোটি টাকা। তার পরই শুরু হয় বিতর্ক। ত্রিফলা বসানোর নামে টাকা নয়ছয়ের অভিযোগের তদন্তে নামে সিএজি। তাদের রিপোর্টে বলা হয়, বাজারদরের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে বাতিস্তম্ভ কেনা হয়েছে। পুর কর্তৃপক্ষের অভিযোগ ছিল, নতুন আলো লাগানোর পর পরই অন্তত এক হাজার বাতি চুরি হয়ে গিয়েছে। কোথাও আবার দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে বাতিস্তম্ভ। পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা জানাচ্ছেন, বাতি থাকা সত্ত্বেও শহরের বহু রাস্তায় ত্রিফলা জ্বলে না। প্রায় তিন হাজার বাতিস্তম্ভ এ ভাবেই অকেজো হয়ে পড়ে ছিল। জন্মলগ্ন থেকেই বিতর্কের মুখে ছিল ত্রিফলা, সেই বিতর্ক নিয়েই বিদায় নিয়েছে সে আলোকস্তম্ভ।
লেক টাউন ভিআইপি রোডের মোড়ে ২০১৫ থেকে রয়েছে অবিকল লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টারের বিশাল বিগ বেন ঘড়ি। ১৩৫ ফুট উঁচু এই ঘড়ি মিনার। তৈরি করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ১.৩৬ কোটি টাকা। লেক টাউনের বিগ বেন কলকাতার জন্য এক দিক থেকে উপযুক্তই বলা যায়— এটি এক দিকে একটি নতুন ল্যান্ডমার্ক তৈরি করেছে, আবার পর্যটনের জন্যও আকর্ষণ বাড়িয়েছে।
নিউ টাউন এখন কলকাতার আধুনিকতার প্রতীক। বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, নিউ টাউন ইউরোপীয় শহরের ধাঁচে গড়ে ওঠা। এই অঞ্চলের স্থাপত্যে বিদেশি ছোঁয়া স্পষ্ট। বিশ্ববাংলা গেটের কাচ ও ইস্পাতের গঠন লন্ডন বা দুবাইয়ের আধুনিক আকাশচুম্বী স্থাপত্যের সঙ্গে সাযুজ্য রাখে, আবার ইকো পার্কের-এর নকশায় স্পষ্ট সিঙ্গাপুরের গার্ডেন সিটি ধারণার প্রভাব। কলকাতা মিউজ়িয়ম অব মডার্ন আর্ট-এর নকশাও তৈরি করছে সুইস স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান হার্জগ এবং ডি মিউরন, যা আন্তর্জাতিক মানের একটি শিল্পকেন্দ্র হওয়ার পথে।
তৃণমূল আমলে দুর্গাপুজো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। দুর্গাপুজোর বিপুল বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। দুর্গাপুজো কার্নিভাল কলকাতায় ২০১৬ সালে শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে। এই আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ হল এর বিদেশি অনুপ্রেরণা— রিয়ো ডি জেনিরো বা লন্ডনের কার্নিভাল থেকে প্রাপ্ত পথশোভা, থিম এবং প্রদর্শনী বাংলার স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশিয়ে একটি অনন্য সাংস্কৃতিক মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে।
অর্থাৎ, বিদেশি অনুকরণগুলির মধ্যে কিছু জিনিস খাপ খেয়ে গিয়েছে কলকাতার সঙ্গে, কিছু জিনিসে নিতান্ত বাজে অর্থব্যয় হয়েছে। কিন্তু, এখানে দু’টি প্রশ্ন করা প্রয়োজন। এক, এই বাহ্যিক পরিবর্তন কি আমাদের সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে? এবং দুই, কলকাতার এই রূপসজ্জার ফলে আমাদের প্রাত্যহিকতায় কোনও বদল হয়েছে কি? ইংল্যান্ড, সুইৎজ়ারল্যান্ড, বা সিঙ্গাপুর-দুবাইয়ের মতো উন্নত পরিষেবা এই দেশে নেই। সে সব দেশের কোনও স্থাপত্য এই রাজ্যে তৈরি হলেও আমাদের জীবনযাত্রা একই ছিল, আছে এবং থাকবে।