নজিরবিহীন! পুরবোর্ড ভাঙা নিয়ে প্রশ্ন তুলে পুরুলিয়া পুরসভাকে শোকজ রাজ্যের
প্রতিদিন | ২২ নভেম্বর ২০২৫
সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: প্রায় দেড়শ বছরের পুর ইতিহাসে পুরুলিয়া পুরসভায় নজিরবিহীন ঘটনা। বোর্ড অফ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে রীতিমতো আদেশনামা জারি করে জানতে চাওয়া হয়েছে, পুর পরিষেবা নিয়ে উদাসীনতার অভিযোগ সত্ত্বেও কেন বোর্ড ভেঙে দেওয়া হবে না? চলতি বছরের ৩ নভেম্বর এই শহরের বাসিন্দাদের গণস্বাক্ষর সম্বলিত একটি অভিযোগপত্র জমা পড়ে। তাতে রাস্তাঘাট অপরিচ্ছন্ন, বেহাল নিকাশি, অনিয়মিত পানীয় জল সরবরাহ এবং শহরের মধ্যে আবর্জনা না সরানোর কথা উল্লেখ রয়েছে। এই বিষয়টিকে সামনে রেখে বোর্ড অফ কাউন্সিল অর্থাৎ পুরবোর্ডের সমস্ত পুর প্রতিনিধি এবং পুরপ্রধানকে কাঠগড়ায় তুলে পুর উদাসীনতার অভিযোগে কেন বোর্ড ভেঙে দেওয়া হবে না? এই প্রশ্ন তুলে সাতদিনের মধ্যে উত্তর চাওয়া হয়েছে। ওই আদেশনামা আদতে কারণ দর্শানোর চিঠি বা শোকজ করা হলেও অতীতে এভাবে উদাসীনতার অভিযোগ তুলে বোর্ড ভেঙে দেওয়ার বিষয় তুলে আনার কোনও উদাহরণ নেই।
গত ১৯ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরের প্রধান সচিবের সই করা ওই আদেশনামা পুরুলিয়া পুরসভায় এসে পৌঁছেছে। বিধি মোতাবেক তা সমস্ত পুর প্রতিনিধির হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনায় রীতিমতো শোরগোল পুরুলিয়া পুরসভায়। পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী সোমবার বোর্ড অফ কাউন্সিলের বৈঠক বসবে। তারপর রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরকে উত্তর দেওয়া হবে। তবে এই বিষয়ে একটা কথাও বলতে চাননি পুরুলিয়ার পুরপ্রধান নবেন্দু মাহালি। পুরুলিয়া জেলার রাজনৈতিক মহল বলছে, এই শোকজের চিঠি আসলে পুরপ্রধানকে সরানোর জন্যই। যেহেতু এই পুরসভায় পুরপ্রধানের বিকল্প কেউ নেই। তাই বোর্ড ভেঙে দিয়ে প্রশাসককে বসানোর পরিকল্পনা চলছে।
২০২২ সালে নবেন্দু মাহালি পুরপ্রধানের চেয়ারে বসার পর থেকেই এই পুরসভার অধিকাংশ পুরপ্রতিনিধিরা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে বিরোধিতা করে আসেন। এমনকী তিনি এই শহরের উন্নয়নের কাজ করতে গিয়েও পুরুলিয়া শহর তৃণমূলের বাধার মুখে পড়েন। যার জন্য পুরুলিয়া জেলা তৃণমূল নেতৃত্বকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। কয়েকমাস ধরে পুরপ্রধানের সঙ্গে একাধিক কাউন্সিলরের বনিবনা না হওয়ায় বিরোধিতা বেড়ে যায়। এবং দলের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিভিন্নভাবে অভিযোগ জানানো হয়। পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, সকল পুরপ্রতিনিধিকে নিয়ে তিনি চলতে পারেন না।
তবে জেলার রাজনৈতিক মহল বলছে, পুরপ্রতিনিধিদের বেনিয়মের কথাতে সায় না দেওয়াতেই পুরপ্রধানের সঙ্গে মতপার্থক্যের প্রাচীর গড়ে উঠেছে। পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে তাঁরা শুধু উদাসীনতার অভিযোগই তোলেননি। তাঁর জীবনযাপন নিয়েও অভিযোগ তুলেছেন। কিন্তু এই শহরের মানুষজন জানেন, বিভিন্ন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি ছাড়াও সাধারণভাবে রাস্তায় নেমে কাজ করেন পুরপ্রধান নবেন্দু মাহালি। তা পানীয় জল হোক বা নিকাশি কিংবা বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা। বিরোধীদের অভিযোগ, গত লোকসভা ভোটে এই পুরশহরে শাসক দলের খারাপ ফলাফলের কারণেই এই বোর্ড অফ কাউন্সিলকে ভেঙে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করা হয়েছে। সমস্তটাই তৃণমূলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
এনিয়ে পুরসভার বিরোধী দলনেতা বিজেপির প্রদীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমরা তো বহুদিন ধরেই বলে আসছি এই পুর শহরে কোনও কাজকর্ম হয় না। শহরের মানুষজন যথার্থ পরিষেবা পান না। আমাদের অভিযোগ যে কতখানি সত্য তা পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরের একটি আদেশনামাতেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।”
এই পুর শহরে ২৩ টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২০২২ সালের পুর নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী ১৭ টি তৃণমূলের দখলে। তিনটি বিজেপির। দুটি নির্দল ও একটি কংগ্রেসের। পরবর্তীকালে দুই নির্দল কাউন্সিলর মৌসুমী ঘোষ ও রুমকি কর্মকার সেই সঙ্গে কংগ্রেসের রুকাইয়া খাতুন আনুষ্ঠানিকভাবে তৃণমূলে যোগ দিলেও সরকারিভাবে তারা শাসক দলের পুর প্রতিনিধির মর্যাদা পাননি। ২০২১ সালের ২৬ শে আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই পুরসভার প্রশাসক ছিলেন নবেন্দু মাহালি। তারপর ২০২২ সালের ২৩ শে মার্চ থেকে তিনি পুরপ্রধানের চেয়ারে রয়েছেন। ওই চেয়ারে বসতে তৃণমূলের বহু পুরপ্রতিনিধি এখন দাবিদার। এই বিষয়টির কথা মাথায় রেখেই বোর্ড অফ কাউন্সিল ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত রাজ্যের। মনে করছে জেলা রাজনৈতিক মহল।
শুধু রাজনৈতিক মহল নয়, পুরুলিয়া পুর এলাকার সাধারণ মানুষেরও মত, যেহেতু লোকসভা ভোটের ফলাফল খারাপ হয়েছে তাই পুরপ্রধানকে সরাতেই হবে। অন্যদিকে, পুরপ্রধানের বিকল্প কেউ নেই বলেই বোর্ডটাকেই ভেঙে দিতে চাইছে রাজ্য। পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরের আদেশনামায় লেখা রয়েছে, উদাসীনতার কারণে এই শহরে যেভাবে আবর্জনা রাস্তায় পড়ে থাকে। তাতে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর মতো রোগ ছড়াতে পারে। ফলে রীতিমতো মুখ পুড়েছে পুরুলিয়া পুর কর্তৃপক্ষের।