• থরহরি পদ্মাপার, কাঁপল কলকাতা, টেকটনিক ‘টাইম বোমা’ বাংলাদেশে, মৃত ১০
    এই সময় | ২২ নভেম্বর ২০২৫
  • কুব‍লয় বন্দ্যোপাধ্যায়

    ১৯৪৫–এর ৬ অগস্ট হিরোশিমায় ‘লিটল বয়’ নামে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণে যে বিপুল পরিমাণে শক্তি উৎপন্ন হয়েছিল, তার চেয়ে অন্তত চারগুণ বেশি শক্তি উৎপন্ন হলো শুক্রবার সকালে বাংলাদেশের ভূগর্ভে। মাটির প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে জন্ম নেওয়া ওই ভূমিকম্পের প্রভাবেই শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে হঠাৎই দুলে উঠল কর্মব্যস্ত ঢাকা। প্রায় ১৯ সেকেন্ডের ওই কম্পনের প্রভাব সীমাবদ্ধ থাকেনি ঢাকা বা বাংলাদেশের চৌহদ্দিতে।

    সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরের কলকাতাও কেঁপে উঠেছিল শুক্রবার সকালে স্থানীয় সময় সকাল ১০টা ০৮ মিনিটে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিজ়মোলজি’– জানিয়ে দেয় কম্পনের উৎপত্তিস্থল ঢাকা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরের নরসিংদি জেলার ঘোড়াশাল।

    রিখটার স্কেল অনুযায়ী ভূগর্ভের প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে জন্মানো ওই ভূমিকম্পের কম্পাঙ্ক ছিল ৫.৭। ইউএস জিওলজিক্যাল সেন্টারের মতে কম্পাঙ্ক ছিল ৫.৫। এই ভূমিকম্পের জন্য বাংলাদেশে দুই শিশু–সহ অন্তত ছ’জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। আহত প্রায় ২০০ জন।

    ২১ নভেম্বর সকালে বাংলাদেশের পাশাপাশি কম্পন অনুভূত হয়েছে কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত প্রায় গোটা পশ্চিমবঙ্গেই। এ ছাড়াও ত্রিপুরা, মণিপুর, অসম–সহ উত্তর–পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যের বিভিন্ন জায়গাতেও ভূমিকম্প নিজের উপস্থিতি অল্পবিস্তর জানান দিয়েছে।

    ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিজ়মোলজি–র তথ্য বলছে শুধু শুক্রবার নয়, গত পাঁচ দিনে মিয়ানমার থেকে ভূটান পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় অন্তত সাত বার ভূমিকম্প হয়েছে। কিন্তু সেই ভূমিকম্পের মাত্রা খুব কম থাকায় মানুষ সেটা অনুভব করতে পারেননি — সবটাই যন্ত্রে ধরা পড়েছে। ভূবিজ্ঞানীরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, এই বছরের মার্চে মিয়ানমারের ভয়াবহ ভূমিকম্পের কথাও।

    কিন্তু কেন উত্তর–পূর্ব ভারত ও তার সংলগ্ন অঞ্চল মাঝে মাঝেই এমন ভাবে ভূমিকম্পের কবলে পড়ে?

    কারণ ব্যাখ্যা করেছেন নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওফিজ়িসিস্ট মাইকেল স্টেকলার। তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক কারণেই বাংলাদেশ ‘টেকটনিক টাইম বোমা’–র উপর বসে রয়েছে বলা যায়। শুক্রবার সেখানে ৫.৭ কম্পাঙ্কের ভূমিকম্প হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই মাত্রা ৯ হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।’

    বিজ্ঞানীরা বোঝার সুবিধার জন্য জানাচ্ছেন ৯ কম্পাঙ্কের ভূমিকম্প তৈরি হতে হলে ভূগর্ভে অন্তত ২৫ হাজার পরমাণু বোমার সমতূল্য শক্তি বিকিরণের প্রয়োজন। কিন্তু ভূগর্ভে এতটা শক্তি বিকিরণ হবে কী করে? অধ্যাপক স্টেকলার বলছেন, ‘বাংলাদেশ ও উত্তর–পূর্ব ভারতের নীচে ‘ইন্ডিয়ান’, ‘ইউরেশিয়ান’ এবং ‘বার্মা’ — এই তিনটি টেকটনিক প্লেট মিশেছে। এ ছাড়াও ওই জায়গায় রয়েছে তিনটি সক্রিয় চ্যুতি রেখা বা ফল্ট লাইন। এরা হলো ‘বগুড়া’, ‘ত্রিপুরা’ এবং ‘ডাউকি’। রয়েছে শিলং ও অসম উপত্যকার মতো ভূতত্ত্বগত ভাবে অত্যন্ত সক্রিয় দু’টি এলাকাও। সব মিলিয়ে গোটা জায়গাটি ভীষণ রকম ভূমিকম্প প্রবণ।’

    বিজ্ঞানীরা মনে করেন পৃথিবীর উপরের স্তরটি আসলে বেশ কয়েকটি বিশাল পাথরের প্লেটের উপর তৈরি হয়েছে। এই প্লেটগুলোকে ‘টেকটনিক প্লেট’ বলা হয়। এদের মধ্যেই ইন্ডিয়ান প্লেটের উপর রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশ। এই প্লেটটি বছরে প্রায় পাঁচ সেন্টিমিটার করে উত্তর দিকে এগিয়ে ইউরেশিয়ান প্লেটের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। এই দুই প্লেটের মাঝে রয়েছে তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই ছোট বার্মা প্লেট।

    তিনটি প্লেটের মধ্যে মাঝেমাঝেই ‘গা–ঘষাঘষি’ হয়। আর তখনই ভূমিকম্প হয় দেশের উত্তর–পূর্বে, মিয়ানমারে এবং বাংলাদেশে। অন্য দিকে চ্যুতিরেখা হলো টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়ার ফলে সৃষ্ট ভূস্তরের দীর্ঘ ফাটল। এই ধরনের ফাটলের মধ্যে যে ফাটলগুলো অতীতে ভূমিকম্প ঘটিয়েছে এবং আগামী দিনেও ভূমিকম্প ঘটানোর অবস্থায় রয়েছে, তাদের ‘সক্রিয় চ্যুতিরেখা’ বলা হয়।

    অধ্যাপক স্টেকলার যে তিনটি ফল্ট লাইনের কথা উল্লেখ করেছেন, তাদের মধ্যে ডাউকি চ্যুতিরেখাটি শিলং উপত্যকার দক্ষিণ দিকে রয়েছে। ত্রিপুরা ফল্ট লাইন বিস্তৃত হয়েছে চট্টগ্রামের দিকে এবং বগুড়া চ্যুতিটি রয়েছে সরাসরি বাংলাদেশের নীচেই। এই কারণেই তিনি বাংলাদেশকে ‘টেকটনিক টাইম বোমার’ উপরে রয়েছে বলে মনে করছেন।

    শুক্রবারের ভূমিকম্প প্রসঙ্গে ভূতত্ত্ববিদ জ্ঞা‍নরঞ্জন কয়ালের মন্তব্য, ‘ভূগর্ভে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত গভীরতায় যে ভূমিকম্পগুলো তৈরি হয়, তাদের ‘শ্যালো আর্থকোয়েক’ বা অগভীর ভূমিকম্প বলা হয়। অল্প দূরত্বের জন্য সহজেই এদের প্রভাব ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত চলে আসে বলে এরা অত্যন্ত বিপজ্জনক।’ শুক্রবার যে ভূমিকম্পটি দুই বাংলাকে ধাক্কা দিল, সেটি অগভীর ভূমিকম্পই ছিল।

    বিজ্ঞানীদের মতে ও পার বাংলার অবস্থান ‘টেকটনিক টাইম বোমা’–র উপরে, কিন্তু তাই বলে এ পার বাংলা কি নিরাপদ? এমনটা একেবারেই নয়। ভূমিকম্প হওয়ার প্রবণার উপর ভিত্তি করে ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিজ়মোলজি দেশকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছে। এর মধ্যে উত্তর–পূর্ব ভারত জ়োন ফাইভ অর্থাৎ ‘সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প–প্রবণ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কলকাতা এবং সংলগ্ন সল্টলেক ও নিউটাউন রয়েছে জ়োন–থ্রি–তে। নরম পলিমাটির উপর দক্ষিণবঙ্গের এই এলাকা তৈরি হয়েছে বলেই এর বিপদ এতটা বেশি বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

  • Link to this news (এই সময়)