কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গে ভূপৃষ্ঠের সাড়ে ৪ কিমি নীচেই বড়সড় চ্যুতি
বর্তমান | ২২ নভেম্বর ২০২৫
নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: বাংলাদেশে মাটির বহু নীচে অবস্থিত ‘মধুপুর ফল্ট’-এর এপিসেন্টার বা উৎসস্থল। সেখান থেকে শুক্রবার সকালে সৃষ্টি হয় তীব্র ভূকম্পন। রিখটর স্কেলে ৫.৭ তীব্রতায় কাঁপিয়ে দিয়েছে ওই দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা। কম্পন কিছুটা অনুভূত হয়েছে কলকাতাসহ দক্ষিণবঙ্গের অনেক স্থানে। তবে প্রবীণ ভূতাত্ত্বিকরা বলছেন, এমনই বেশ বড়ো ধরনের ভূমিকম্প ঘটানোর মতো পরিস্থিতি রয়েছে খোদ কলকাতার মাটির তলাতেই। দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ জুড়ে ভূমিকম্প সৃষ্টিকারী এরকম অনেক অনুকূল পরিস্থিতি রয়েছে। ভূগর্ভস্থ সংঘাত, চাপ প্রভৃতি থেকে সৃষ্টি হওয়া ‘ফল্ট’ (চ্যুতি), ‘হিনজ জোন’ প্রভৃতি হল শক্তিশালী ভূমিকম্পের উৎসস্থল। এর মধ্যে এমনই একটি হল ‘ইওসিন হিনজ জোন’। এটি সুন্দরবনের সাগরদ্বীপ থেকে শুরু হয়ে কলকাতার নীচ দিয়ে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ পর্যন্ত বিস্তৃত বলে জানিয়েছেন, জিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অবসরপ্রাপ্ত ডিরেক্টর শিখেন্দ্র দে। কলকাতা সহ রাজ্যে ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণামূলক বহু কাজ করেছেন খড়্গপুর আইআইটির জিয়োলজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শংকরকুমার নাথ। তিনি বর্তমানে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। শংকরবাবু জানিয়েছেন, ইওসিন হিনজ কলকাতার মাটির সাড়ে ৪ কিমি নীচ দিয়ে গিয়েছে। এখান থেকে সৃষ্ট কোনও ভূমিকম্পের উৎসস্থলের তীব্রতা রিখটার স্কেলে ৬.৮ মাত্রা পর্যন্ত হতে পারে। এদিন বাংলাদেশের নরসিংদি এলাকার উৎসস্থলের ভূমিকম্পটির তীব্রতা রিখটর স্কেলে ছিল ৫.৭।
অতীতে এই জায়গায় শক্তিশালী ভূকম্পন সৃষ্টি হয়েছে বলে ভূতাত্ত্বিকরা জানিয়েছেন। শংকরবাবু জানান, ১৮৮৫ সালে ইওসিন হিনজে রিখটার স্কেলে ৬.৭ তীব্রতার ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়েছিল। এই ভূমিকম্পটির ফলে বেশি ক্ষয়ক্ষতি অবশ্য হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে। অতীত রেকর্ড থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৬৪ সালের ১৫ এপ্রিল রিখটার স্কেলে ৫.২ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল সাগরদ্বীপ এলাকা। এই ভূমিকম্প ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়েছিল কলকাতাসহ দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায়। এটির সৃষ্টিও ইওসিন হিনজে হয় বলে মনে করা হয়। ভূমিকম্পের উৎসস্থলের মাত্রা যান্ত্রিকভাবে পরিমাপ করার ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে উৎসস্থলের নিরিখে এটা তীব্রতম ভূমিকম্প বলে মনে করেন ভূবিশেষজ্ঞরা।
এটা ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি ‘ফল্ট’ ছড়িয়ে রয়েছে রাজ্যজুড়ে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—গড়মোহানা ও খণ্ডঘোষ ফল্ট, পিংলা ফল্ট, রাজমহল ফল্ট, জঙ্গিপুর-গাইবান্ধা ফল্ট, মালদহ-কিষেনগঞ্জ ফল্ট, মেদিনীপুর-ফরাক্কা ফল্ট, নদার্ন রিজিয়ন ফল্ট প্রভৃতি। এসব জায়গায় অতীতে বহুবার ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়েছে। তীব্রতার মাত্রা বেশি না-হওয়ায় ওইসব ভূমিকম্প নিয়ে বেশি হইচই হয়নি। তবে এই ধরনের ফল্ট, হিনজ জোন প্রভৃতি থেকে যেকোনও সময় বড়ো ধরনের ভূমিকম্পের উৎপত্তি হতে পারে বলে ভূতাত্ত্বিকরা মনে করছেন। কলকাতা বা কাছাকাছি এলাকায় কোনও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের উৎসস্থল হলে তার ভালোরকম প্রভাব মহানগরীতে পড়বে বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কলকাতা থেকে অনেকটা দূরে কোনও অতিশক্তিশালী ভূমিকম্প হলেও তার প্রভাব এই শহরে ভালোরকম হতে পারে। যেমনটা হয়েছিল ১৯৩৪ সালে ৮-এর বেশি মাত্রায়, বিহার ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে। কলকাতায় বেশি মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হলে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক হবে রাজারহাট-নিউটাউন, সল্টলেক এলাকায়। মনে করেন শংকরবাবু। কারণ এখানে জলা ভরাট করে স্থলভূমি সৃষ্টি করার জন্য একটু শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে ভূগর্ভে ‘লিকুইফ্রাকশন’ বেশি হবে। ফলে মাটিতে ধস নামবে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে ভূমিকম্প প্রতিরোধক বিধি মেনে নির্মাণকাজ করতে হবে। পুরোনো যে ভবনগুলি আছে সেগুলিকেও মজবুত করার জন্য নিতে হবে বিশেষ ব্যবস্থা।