তৃণমূলের ‘বুথশক্তি’ ভোঁতা করে দিতে কৌশলী রাস্তায় বিজেপি, কমিশনের উপর ‘চাপ’ বাড়িয়ে বঙ্গে ‘অঙ্গ মডেল’ চায় পদ্মশিবির
আনন্দবাজার | ২২ নভেম্বর ২০২৫
বিহারের ভোটে বিপুল ভাবে এনডিএ-র প্রত্যাবর্তনের পরে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা চত্বরে লাড্ডু বিলি করেছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। উপস্থিতদের মিষ্টিমুখ করাতে করাতে ওড়িশা, বিহার এবং বাংলাকে একই তারে বেঁধে শুভেন্দু বলেছিলেন, ‘‘কলিঙ্গ আগেই হয়ে গিয়েছে। অঙ্গও হয়ে গেল। এ বার হবে বঙ্গ।’’
রাজ্যের বিরোধী দলনেতার ওই হুঁশিয়ারি যে শুধু কথার কথা ছিল না, তার প্রমাণ মিলতে শুরু করেছে। বাস্তবেও বঙ্গের ভোটে ‘বিহার মডেল’ কার্যকর করার প্রস্তুতি শুরু করে দিল পদ্মশিবির। যার মূল উদ্দেশ্য, তৃণমূলের বুথের শক্তিকে ভোঁতা করা।
ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) প্রক্রিয়া যখন পশ্চিমবঙ্গে পক্ষকাল পার করে ফেলেছে, তখন ভোটের দিনের কথা মাথায় রেখে ঘুঁটি সাজাতে চাইছে বিজেপি। এ ব্যাপারে পদ্মশিবিরের ‘ভরসা’ নির্বাচন কমিশন। রাজ্য বিজেপির একটি অংশ চাইছে, ভোটের প্রক্রিয়া সংক্রান্ত নির্দেশিকায় (এসওপি) কিছু বদল করা হোক। যা বুথের ভিতর তৃণমূলের শক্তিকে কিছুটা হলেও দুর্বল করে দেবে।
বিহারের ভোটে দেখা গিয়েছে, নির্বাচনের দিন রাজনৈতিক দলের পোলিং এজেন্টরা ভোটকক্ষের বাইরে টেবিল বা বেঞ্চ পেতে বসেছিলেন। কক্ষের দুয়ারে প্রহরায় ছিলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান। আর ভিতরে ভোট পরিচালনা করেছেন সরকারি কর্মচারীরা (প্রিসাইডিং অফিসার, প্রথম ও দ্বিতীয় পোলিং অফিসার)। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গেও তা কার্যকর করাতে চায়। সেই উদ্দেশ্যেই বিহারের নির্বাচনের দিনের বিভিন্ন এলাকার ভিডিয়ো ফুটেজ জোগাড় করা হচ্ছে। সূত্রের খবর, তেমন কিছু ভিডিয়ো পাঠানো হয়েছে শুভেন্দুর কাছেও। যাতে কমিশনে ‘তথ্যনিষ্ঠ’ দাবি জানানো যায়। শুধু তা-ই নয়। বিজেপি চাইছে, বুথের ভিতর প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানকেও যৌথ ভাবে ‘ম্যাজিস্টেরিয়াল পাওয়ার’ দেওয়া হোক। বিজেপির এক নেতার কথায়, ‘‘এসআইআরের ফলে তৃণমূল ধাক্কা খাবে। তবে সেই ধাক্কা তখনই ভোটে প্রতিফলিত হবে, যখন ভোটের দিন বুথ নিরাপদ রাখা সম্ভব হবে। মনে রাখতে হবে, সরকারি কর্মচারীরা কিন্তু দিনের শেষে তৃণমূলেরই নিয়ন্ত্রণে।’’
এসওপি বদলের বিষয়ে বিজেপি-কে বাড়তি উৎসাহ জুগিয়েছে এসআইআর চলাকালীন কমিশনের নিয়ম বদলের নির্দেশিকা। রাজনৈতিক দলগুলির তরফে এসআইআর প্রক্রিয়ায় যুক্ত রয়েছেন বুথ লেভেল এজেন্টরা (বিএলএ)। এত দিন পর্যন্ত বিএলএ নিয়োগে কমিশনের নিয়মে কড়াকড়ি ছিল। ২০২৩ সালের নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, যে কোনও রাজনৈতিক দলের তরফে যদি কেউ বিএলএ হন, তাঁকে সেই বুথেরই ভোটার হতে হবে। কিন্তু এই নিময় বদল করে গত সপ্তাহের মঙ্গলবার কমিশন জানায়, বিএলএ হতে গেলে নির্দিষ্ট বুথের ভোটার না-হলেও চলবে। সংশ্লিষ্ট বিধানসভার ভোটার হলেই হবে। কমিশনের ওই নির্দেশিকাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন শুভেন্দু। পাল্টা তৃণমূল বলেছিল, এ হল কমিশন আর বিজেপির ‘গাঁটবন্ধন’। বিজেপির হয়ে বিএলএ খুঁজে দেওয়ার ইজারা নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু বাস্তব হল, নিয়মের বদল ঘটে গিয়েছে। সেই সূত্রেই বিজেপি ‘এসওপি’ বদলের কৌশলে মন দিচ্ছে।
যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূল বিজেপির কৌশলকে আমল দিচ্ছে না। শাসকদলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের কথায়, ‘‘বিজেপি যে বাংলা এবং বাঙালি বিদ্বেষী, তা সর্বজনবিদিত। ওরা আগে বাংলার প্রতি নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাক। নইলে নিয়ম বদল করে কী হবে? ভোটের শেষে তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই চতুর্থ বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হবেন।’’ তবে একান্ত আলোচনায় তৃণমূলের নেতাদের অনেকেই মানছেন, বুথে দলের যে সাংগঠনিক শক্তি রয়েছে, তা যদি ভোটের দিন প্রতিফলিত না-করা যায়, তা হলে অনেক জায়গায় বিড়ম্বনা তৈরি হবে।
তবে যে বিজেপি নেতারা নিয়ম বদলের জন্য ‘রসদ’ জোগাড় করছেন, তাঁরাও মানছেন, আসল ‘খেলা’ ভোটের আগের দিন রাত এবং ওই দিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত। একান্ত আলোচনায় তাঁরা অকপটেই মেনে নিচ্ছেন যে, বুথের শক্তিতে তৃণমূলের সঙ্গে এঁটে ওঠা সম্ভব নয়। চার মাসের মধ্যে রাতারাতি সমপর্যায়ের শক্তি অর্জন করাও অসম্ভব। ফলে নিয়ম বদল করে কৌশলে তৃণমূলের শক্তি কমিয়ে দেওয়ার রাস্তায় যেতে চান তাঁরা। এক নেতার কথায়, ‘‘বহু বুথ এমন রয়েছে, যেখানে আমরা এজেন্ট দিতে পারব না। দলীয় প্রার্থীর পাশাপাশি সেখানে ডামি প্রার্থীদের এজেন্ট বসিয়ে তৃণমূল সংখ্যাধিক্যের চাপ তৈরি করে। সেটা রুখতে পারলে বহু জায়গায় ছবি বদলে যেতে পারে।’’
তবে এর পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। তাদের বক্তব্য, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে তৎকালীন বিজেপি নেতা মুকুল রায় কমিশনে তদ্বির করেছিলেন এই মর্মে যে, বিধানসভার ভোটার হলেই তাঁকে সেই কেন্দ্রে ভোটের দিন যে কোনও বুথে এজেন্ট করার অনুমতি দেওয়া হোক। শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে ভোটের দিন ‘ওয়ান ডে’ ম্যাচে দেখা গিয়েছিল অচেনা পিচের ঘূর্ণি সামলাতে পারছেন না বিরোধী এজেন্টরা।
নিয়ম বদলের জন্য ‘চাপ’ তৈরি করবে বিজেপি। কিন্তু তা দিয়ে সাংগঠনিক দৈন্যের ছবি কি বদলাবে?