• নামমাত্র বেতনে স্কুলে ঝাড়ু প্রজন্মের পর প্রজন্মের, মেলেনি সরকারি স্বীকৃতি
    এই সময় | ২২ নভেম্বর ২০২৫
  • অর্ঘ্য ঘোষ, ময়ূরেশ্বর

    বাপ-ঠাকুরদারা মাসিক পঞ্চাশ পয়সা থেকে পঞ্চাশ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেছিলেন। আর এখন মাসিক পাঁচশো থেকে দু'হাজার টাকায় কাজ করছেন কারও নাতি, কারও ছেলে মেয়ে বা নাতবৌ। আসলে সরকারি কর্মী হিসাবে স্বীকৃতির আশায় নামমাত্র পারিশ্রমিকে স্কুলে ঝাড় দিয়ে চলেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

    শিক্ষা দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্যের অধিকাংশ স্কুলে ঝাড়ুদার এবং নৈশরক্ষীর কোনও স্বীকৃত পদ নেই। অথচ জন্মলগ্ন বহু স্কুলেই থেকে সামান্য বেতনে ৩-৪ প্রজন্ম ধরে অনেকেই কাজ করে চলেছেন। স্কুল শুরুর সময়ে উদ্যোক্তারা আশ্বাস দিয়েছিলেন 'ভবিষ্যতে সরকারি কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি মিলবে'।

    কিন্তু সেই স্বীকৃতি আজও মেলেনি। অর্থাভাব আজও সঙ্গী এই অস্থায়ী কর্মীদের। নিজেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বেশিরভাগের ছেলেমেয়ের পড়াশোনা হয়নি।

    ১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত লাভপুরের বিপ্রটিকুরি হাইস্কুলে মাসিক ৫০ টাকা বেতনে ঝাড়ুদারের কাজ নেন প্রয়াত পঙ্খীরাম হাজরা। তাঁর মৃত্যুর পরে ৩০০ টাকা বেতনে প্রথমে তাঁর ছেলে শঙ্কর এবং এখন মাসিক ২০০০ টাকা বেতনে তাঁর ছেলে সুদেব কাজ করছেন। একই দশা ময়ূরেশ্বরের লোকপাড়ার সঞ্জিত দলুই, আমোদপুর সাহানিপাড়ার মাধবী বাদ্যকরেরও।

    ১৯১৩-এ ময়ূরেশ্বর লোকপাড়া মধ্য ইংরাজি স্কুলে মাসিক ৫০ পয়সা বেতনে ঝাড়ুদারের কাজে বহাল হন যশোদা দলুই। তাঁর মৃত্যুর পরে মাসিক ৫০ টাকা বেতনে এই কাজ করতেন তাঁর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ছেলে ষষ্ঠী দলুই।

    ১৯৮৮-এ তাঁর মৃত্যুর পরে ছেলে সুশান্ত ঝাড় দেওয়া শুরু করেন। স্কুল উচ্চ মাধ্যমিকের স্বীকৃতি লাভ করলেও সরকারি কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি পাননি সুশান্ত। দীর্ঘ দিন মাসিক ৫০০ টাকা বেতনে কাজ করে ২০১০-এ স্থানীয় কলেজে নৈশরক্ষী হিসাবে কাজ পেয়েছেন। তাঁর জায়গায় মাসিক ১৫০০ টাকা বেতনে একই কাজ করে চলেছেন ছেলে সঞ্জিত। সবাই অবশ্য সুশান্তর মতো অন্য চাকরি পাননি। ১৯৬৭-এ প্রতিষ্ঠিত আমোদপুর শ্রীরামকৃষ্ণ হাইস্কুলে ৫০ টাকা বেতনে ঝাড়ুদারের কাজ নেন বনকুমার বাদ্যকর। ২০০৫-এ তাঁর মৃত্যুর পরে মাসিক ২০০ টাকা বেতনে যোগ দেন স্ত্রী রেবা।

    ২০১৯-এ তাঁরও মৃত্যু হলে রেখার পুত্রবধূ মাধবী ওই কাজ নেন। বর্তমানে তাঁর বেতন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০০ টাকা। ১৯৭৫-এ মাড়গ্রামের সংগঠিত বসোয়া বালিকা বিদ্যালয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে নৈশরক্ষী হিসাবে কাজ শুরু করেন সাদরে আলা খাঁ। ১৯৮৩- এ স্কুলটি হাইস্কুলের অনুমোদন পেলে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ শুরু করা শিক্ষিকা এবং শিক্ষাকর্মীরা সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি পেলেও স্থায়ী হননি সাদরে।

    বছর পাঁচেক আগে তাঁর মৃত্যু হয়। এখন মাসিক ১৫০০ টাকা বেতনে কাজ করছেন তাঁর মেয়ে হামিদা বিবি। বিপ্রটিকুরি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রণব খাঁ, শ্রীরামকৃষ্ণ হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গণেশচন্দ্র মণ্ডল, লোকপাড়া হাইস্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি জয়ন্ত ভট্টাচার্য এবং বসোয়া বালিকা বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা চন্দ্রা মণ্ডল বলেন, 'স্কুল পরিচালন ব্যয় বাবদ বরাদ্দ টাকা থেকে ওঁদের বেতন দিতে হয়। সরকার ওইসব পদে স্থায়ী কর্মী নিয়োগের কথা ভাবলে আমরাও স্বস্তি পাই।'

    পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতির জেলা সাধারণ সম্পাদক অধীরকুমার দাস বলেন, 'সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম বেতনটুকুও ওঁরা পান না। মাঝখান থেকে আশায় আশায় তাঁদের জীবনের সেরা সময়টুকু চলে যায়।' তৃণমূলের জেলা কোর কমিটির চেয়ারম্যান তথা বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'বিষয়টি না জেনে মন্তব্য করব না।'

  • Link to this news (এই সময়)