লাল সন্ত্রাসমুক্ত হবে দণ্ডকারণ্য! হিদমার মৃত্যুই কি মাওবাদের কফিনে শেষ পেরেক?
প্রতিদিন | ২২ নভেম্বর ২০২৫
বিশ্বদীপ দে: ১৮ নভেম্বর, ভোর ৬টা। ছত্তিশগড় সীমানা থেকে ১০০ কিমি দূরে অবস্থিত মাল্লুরি সীতারামা রাজু জেলার মারেদুমিল্লির জঙ্গল। আকাশে সবে দেখা দিয়েছে সূর্য। পাখির কলকাকলি ও ঠান্ডা বাতাসে অরণ্যে যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে আদিম পৃথিবীর সুঘ্রাণ। আচমকাই সেই তন্ময়তা ছিঁড়ে দিল গুলির শব্দ। একটা-দু’টো নয়। একটানা। একদিকে মাওবাদীরা। অন্যদিকে অন্ধ্রপ্রদেশের পুলিশ। শেষপর্যন্ত সেই গুলির লড়াইয়ে প্রাণ হারান মাওবাদী নেতা হিদমা-সহ মোট ৬ জন। কিষেনজির মৃত্যুর পরে মাওবাদী আন্দোলনের অন্যতম শক্তিশালী নেতা হিসেবে উঠে এসেছিল হিদমার নাম। মাথার দাম ছিল সব মিলিয়ে ১.৮ কোটি টাকা! তাঁর মৃত্যুতে মাওবাদী আন্দোলন জোর ধাক্কা খেয়েছে। এতদিন তিনিই ছিলেন ‘ব্যাটেলিয়ন নম্বর ১’। এবার সেই পদে বর্সে দেবা, হিদমারই পুরনো সঙ্গী। কিন্তু আদপে পরিস্থিতি যা, তাতে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে এবার ভারতে মাওবাদী আন্দোলন একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে। অর্থাৎ হিদমার মৃত্যুই এদেশে মাওবাদের কফিনে শেষ পেরেক হতে চলেছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
১৯৮১ সালে ছত্তিশগড়ের সুকমা জেলার পুবার্তি গ্রামে জন্ম হিদমার। গত শতকের নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মাওবাদী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া স্কুলছুট কিশোরটির। একদিকে সাহসিকতা, অন্যদিকে বুদ্ধিমত্তা- দুইয়ের মিশেলেই দ্রুত দলীয় নেতৃত্বের নজরে পড়ে যান তিনি। এই পুবার্তি গ্রামটি ছিল মাওবাদীদের ‘খামার’। শাকসবজি চাষ করা হত দলের ‘ভাঁড়ার’ হিসেবে। যদিও ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সিআরপিএফ পুবার্তিতে নতুন ঘাঁটি তৈরি করা থেকেই পরিষ্কার পরিস্থিতি কতটা বদলে গিয়েছে গ্রামটির।
কেন এত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে হিদমার মৃত্যুকে? আসলে দীর্ঘ সময় ধরেই লড়াই চালানোর দক্ষতা ও কৌশল তাঁকে দলে অপরিহার্য করে তুলেছিল। সবচেয়ে নিখুঁত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মাওবাদীকেই ‘ব্যাটেলিয়ন নম্বর ওয়ান’-এর তকমা দেওয়া হয়। হিদমা ছাড়া এই পদের উপযুক্ত এই মুহূর্তে ভাবাই সম্ভব ছিল না। অভিজ্ঞ এই মাওবাদী নেতার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে অন্তত ২৪টি ভয়াল হামলার অভিযোগ রয়েছে। জঙ্গল ছিল তাঁর নখদর্পণে। গ্রামে গ্রামে ছিল নেটওয়ার্ক। পরিচিত সূত্রে অনায়াসেই খবর পৌঁছে যেত নিরাপত্তা বাহিনীর গতিবিধির। ফলে অনায়াসে জঙ্গলের গভীর থেকে গভীরে হারিয়ে গিয়ে এতদিন অধরাই হয়ে থাকছিলেন। এহেন মানুষের মৃত্যু তাই দেশে মাওবাদী আন্দোলন খতম করার ক্ষেত্রে বিরাট ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। গত মে মাসে মারা যান আরেক শীর্ষস্থানীয় মাওবাদী নেতা বাসবরাজু। সেই মৃত্যুর কয়েক মাসের মধ্যে হিদমার মৃত্যু মাওবাদী আন্দোলনকে বিপুল ধাক্কা দিল। কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মাওবাদী)-র সেন্ট্রাল কমিটির সদস্যদের মধ্যে হিদমাই একমাত্র মুখ যিনি ছত্তিশগড়ের বাসিন্দা। মূলত সুকমা, বিজাপুর, দান্তেওয়াড়ার মাওবাদী নেটওয়ার্ক ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল, ছত্তিশগড় ও অন্ধ্র-তেলেঙ্গানা সীমানার প্রান্তের জঙ্গলে আত্মগোপন করে রয়েছেন হিদমা। এবছরের শুরুতে অন্তত তিন থেকে চারবার ধরা পড়ার হাত থেকে কোনওমতে বেঁচে গিয়েছেন তিনি। যার মধ্যে অক্টোবরের শেষের লড়াই ছিল তীব্র। কিন্তু কোনওমতে পালিয়ে তেলেঙ্গানার গভীর জঙ্গলে ঢুকে যান হিদমা। গত সপ্তাহে ছত্তিশগড়ের উপমুখ্যমন্ত্রী বিজয় শর্মা দেখা করেন হিদমার মায়ের সঙ্গে। সেই সময় তিনি আবেদন করেন হিদমার আত্মসমর্পণের। কিন্তু শেষপর্যন্ত হিদমার মৃত্যু হল নভেম্বরে।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এরপর কী? সূত্রানুসারে, সিপিআই (মাওবাদী) সংগঠনে পাঁচ সদস্যের পলিট ব্যুরোই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন। এই পাঁচজনের মধ্যে একজন বাসবরাজু। তিনিও মারা গিয়েছেন। অন্যজন গণপতির বয়স হয়ে গিয়েছে। মিশির বেসরা নিষ্ক্রিয়। এবার হিদমাও মৃত। কেবলমাত্র বর্সে দেবাই রয়েছেন। সর্বোচ্চ নেতৃত্বের এই ফাঁক, এই শূন্যতাই বুঝিয়ে দিচ্ছে পরিস্থিতি কেমন।
২০২৬ সালের মার্চ মাসের মধ্যে দেশ থেকে মাওবাদকে পুরোপুরি নির্মূল করা হবে বলে আগেই বিভিন্ন জনসভায় জানিয়ে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সেই লক্ষ্যে জোরকদমে শুরু হয়েছে কাজ। গত কয়েক মাসে ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র-সহ একাধিক রাজ্যে আত্মসমর্পণ করেছেন কয়েকশো মাওবাদী। স্পষ্ট ভাষায় শাহ জানিয়েছেন, “যারা হিংসা ত্যাগ করে মূল স্রোতে ফিরছে তাদের স্বাগত। কিন্তু যারা এখনও বন্দুক চালিয়ে যাবে তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর মারণ শক্তির মুখোমুখি হতে হবে।” বিশেষজ্ঞদের ধারণা, দেশে মাওবাদী আন্দোলন এখন একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। পরপর শীর্ষনেতাদের মৃত্যু, গ্রেপ্তারি, নিষ্ক্রিয়তা সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।