• আমার সোনার বাংলা
    বর্তমান | ২৩ নভেম্বর ২০২৫
  • অনিরুদ্ধ সরকার: দিল্লির মসনদে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব। বাংলার দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁ। বাংলার রাজধানী তখনও ঢাকা। ১৭০৪ সালে রাজধানী ঢাকা থেকে ‘মুকসুদাবাদে’ নিয়ে আসেন মুর্শিদকুলি। নতুন নামও দেন, ‘মুর্শিদাবাদ’। ইংরেজ আমলে তা স্থানান্তরিত হয়, গোটা ভারতবর্ষেরই রাজধানী হয়ে ওঠে কলকাতা। ব্যবসা-বাণিজ্য, উন্নয়ন সহ সব দিক থেকেই পূর্ব বাংলা পিছিয়ে পড়তে থাকে। পূর্ব বাংলার জমিদার ও ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন এই নতুন রাজধানীতে। জন্ম নেয় ‘বাবু কালচার’।

    শ্রীচৈতন্যের আমলের সংস্কৃত টোলগুলি তখন বন্ধের মুখে। ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত ‘নব্য কেরানি সমাজ’ হঠাৎ অনুভব করে যে সরকারি চাকরিতে সাহেবদের তুলনায় দেশীয়দের নিয়োগে বৈষম্য রয়েছে। দিনে দিনে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৈষম্য, ব্রিটিশদের নানাবিধ অত্যাচার ইত্যাদি কারণে বাংলায় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। অল্পদিনেই বিপ্লবী আন্দোলনের আতুঁড়ঘরে পরিণত হয় সমগ্র বঙ্গদেশ। স্বভাবতই ব্রিটিশদের কপালে ভাঁজ পড়ে। জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করার চিন্তাভাবনা শুরু হয়। আর তখনই প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে তৈরি হয় বঙ্গভঙ্গের খসড়া।

    ১৯০২ সাল। তৎকালীন সেন্ট্রাল প্রভিন্সের (মধ্যপ্রদেশ) লেফটেন্যান্ট গভর্নর অ্যান্ড্রু ফ্রেজার ওড়িশা ও সম্বলপুরকে বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে সরিয়ে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব রাখেন। এরপরই তাঁকে বাংলার গভর্নর বা ছোটোলাট হিসেবে নিযুক্ত করেন লর্ড কার্জন। এই ফ্রেজারই ছিলেন বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে লর্ড কার্জনের প্রধান উপদেষ্টা।

    ১৯০৩ সালে বাংলাকে ভাগ করার একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেন ফ্রেজার। ওই প্রস্তাবে পার্বত্য ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে অসম, ছোটোনাগপুরকে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করার কথা বলা হয়। উলটোদিকে মধ্যপ্রদেশ থেকে সম্বলপুর ও চেন্নাই থেকে গঞ্জামকে মিশিয়ে দিতে বলা হয় বাংলায়। এটাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, এই প্রস্তাব কার্যকরী হলে বাংলার লোকসংখ্যা কমবে। কার্জন ও ফ্রেজার বুঝেছিলেন, জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপ রুখতে বিপ্লবী ‘হিন্দু’ বাঙালিদের উভয় প্রদেশেই সংখ্যালঘু করতে হবে। আর পূর্ববঙ্গ ও অসম প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে ক্ষমতা বাড়বে, এই সম্ভাবনা দেখিয়ে মুসলিমদের এই প্রস্তাবের পক্ষে নিয়ে আসা যাবে। ঢাকার নবাবকে ক্ষমতার লোভ ও অল্প সুদে অনেক টাকা কর্জ দিয়ে তাঁকে নিজেদের পক্ষে টেনে নিলেন কার্জন। 

    এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বাংলাজুড়ে আন্দোলনের ঝড় ওঠে। পূর্ববঙ্গের মানুষ প্রথমদিকে বঙ্গভঙ্গের পক্ষ নিলেও পরে ভুল বুঝতে পারেন। দু’মাসের মধ্যে পূর্ববঙ্গজুড়ে পাঁচশোরও বেশি সভা হয়। বঙ্গভঙ্গের কুফল জানিয়ে দেশজুড়ে হাজার হাজার পুস্তক বিলি করা হয়। দেশীয় সংবাদপত্র ছাড়াও ইংরেজদের মুখপত্র ‘ইংলিশম্যান’-এও এই প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা করা হয়।

    ১৯০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি অস্থায়ী ভারত সচিবকে একটি পত্র লেখেন লর্ড কার্জন—‘বাঙালিরা নিজেদের এক মহাজাতি মনে করে। তারা স্বপ্ন দেখে যে একদিন ইংরেজরা ভারত থেকে বিতাড়িত হবে। আর তখন কলকাতার লাটপ্রাসাদে এসে বসবেন কোনও একজন বাঙালিবাবু। সুতরাং কলকাতার মানুষ বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের অবশ্যই বিরোধিতা করবে। আমরা যদি বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবে তাদের আপত্তির কাছে নতি স্বীকার করি, তবে ভবিষ্যতে কোনওদিনই বাংলা ভাগ করতে পারব না। এবং আপনারা ভারতের পূর্বপার্শ্বে এমন এক শক্তিকে জোরদার করবেন যা এখনই প্রবল এবং ভবিষ্যতে বিপদের উৎস হয়ে দাঁড়াবে।’

    ১৯০৫ সালের মে মাসে লন্ডনের ‘স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হল, ইংল্যান্ডে এই বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। ১৯০৫ সালের ৭ জুলাই সিমলা থেকে ভারত সরকার এই প্রস্তাব ঘোষণাও করে। ইংরেজি ও বাংলায় প্রকাশিত দেশীয় সংবাদপত্রগুলিতে এর তীব্র নিন্দা করা হয়। ইংরেজি ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন, ‘এই বঙ্গভঙ্গ আমরা কিছুতেই মানিয়া লইব না। যতদিন ইহা রহিত না হয় ততদিন আইনসঙ্গত উপায়ে আমরা যে আন্দোলন চালাইব, ব্যাপকতা ও তীব্রতায় তাহার সমতুল্য কোন আন্দোলন ইহার পূর্বে এদেশে আর কখনও হয় নাই।’ কয়েকদিনপর, ১৯ জুলাই ভাইসরয় লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করেন। ১৬ অক্টোবর তা কার্যকর হয়।

    বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় কলকাতার টাউন হলে পাঁচটি বিরাট সভা হয়। এই সভাগুলিতে রাজা-মহারাজা-জমিদার, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষ হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। ৭০ হাজার লোকের স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবাদপত্র পাঠানো হয় ইংল্যান্ডে। বাঙালি নেতারা বাংলার সংবিধান সভায় তীব্র প্রতিবাদ করেন। নেতা অম্বিকাচরণ মজুমদার বলেন, ‘খুনী আসামীকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয় কিন্তু তিন কোটি বাঙ্গালীকে কোন কথা বলিবার সুযোগ না দিয়াই তাহাদিগের চরম দুর্ভাগ্যের ব্যবস্থা করা হইল।’ ‘হিতবাদী’, ‘সঞ্জীবনী’, ‘সন্ধ্যা’, চারুমিহিরের মত পত্রিকা লিখল, ‘বঙ্গভঙ্গ হলে নিজ বাসভূমে বাঙালিকে সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে থাকতে হবে।’

    বঙ্গদেশে বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে পড়ল। ইংরেজ মদতপুষ্ট যে জমিদাররা সাধারণত ব্রিটিশ বিরোধিতা করতেন না, রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগদান করতেন না, তাঁরাও পথে নামলেন। খালি পায়ে হাজার হাজার মানুষ প্রবল জল-ঝড় উপেক্ষা করে মহালয়ার ভোরে কালীঘাট মন্দিরে সমবেত হলেন। পুজো দিলেন। প্রার্থনা করলেন, যেন বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। বিলাতি বস্ত্র বর্জনের শপথ নিলেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের জন্য ‘অরন্ধন’ পালনের কথা বললেন। কলকাতা কার্যত স্তব্ধ হয়ে গেল সেদিন। গাড়ি-ঘোড়া সব বন্ধ। রাস্তাজুড়ে কাতারে কাতারে লোক। সবাই খালি পায়ে। সেদিন উচ্চস্বরে যেমন ধ্বনিত হল ‘বন্দেমাতরম’, তেমনই ধ্বনিত হল রবি ঠাকুরের লেখা গান... ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’। গাইতে গাইতে আন্দোলনকারীরা যান জগন্নাথ ঘাটের দিকে। সেখানেই মানুষ গেয়ে ওঠে, ‘আমার সোনার বাংলা’। রাস্তার দু’পাশে তখন লোকে লোকারণ্য। মেয়েরা কেউ শাঁখ বাজিয়ে বা দোতলার বারান্দা থেকে ফুল ছুড়ে আন্দোলনকারীদের সম্মান জানাতে লাগলেন। 

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়াও সেদিন সেই মিছিলে ছিলেন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো দিকপালরা। সেদিন রাখি পূর্ণিমা ছিল না। কিন্তু সবাই গঙ্গা স্নান সেরে বিডন স্কোয়ার ও কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে পরস্পরের হাতে রাখি বেধে বঙ্গ-ব্যবচ্ছেদের জন্য শোকপ্রকাশ করলেন। রাখিবন্ধনের মন্ত্রটি ছিল, ‘ভাই ভাই এক ঠাই’।

    বিকেলের দিকে আপার সার্কুলার রোডে এক বিরাট জনসভা হল। সভাপতি ছিলেন আনন্দমোহন বসু। তিনি অসুস্থ। তাও সভাস্থলে আনা হল আরামকেদারায় করে। জমায়েত ছিল ৮০ হাজার। ভাষণ দেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণকুমার মিত্রের মতো নেতারা। এত বড়ো জনসভা কলকাতা আগে দেখেনি। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের জন্য তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিলেন জাতীয় নেতৃত্ব। সেদিন মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সংগ্রহ হয়েছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। রবি ঠাকুর বললেন, ‘বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদের কুফল নাশ করতে এবং বাঙালি জাতির একতা সংরক্ষণ করতে আমরা সমস্ত বাঙালি জাতি আমাদের শক্তিতে যা কিছু সম্ভব তার সবই প্রয়োগ করব।’

    সভাভঙ্গের পর বিপুল জনতা পশুপতি বসুর বাড়ির দিকে রওনা হল। রবি ঠাকুরও সেই মিছিলে। কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হল, ‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে ততই বাঁধন টুটবে’। তারপরই খোলা গলায় গেয়ে উঠলেন, ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান...।’ সেদিন সন্ধ্যাবেলায় পশুপতি বসুর বাড়ির সামনের জনসভায় লোকসংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষের মতো।

    তিন সপ্তাহ পর, দশমীর পরদিন পশুপতি বসুর বাসভবনে একটি বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠিত হয়। ময়মনসিংহের মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য, নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে উপস্থিত রবি ঠাকুরও। বলেছিলেন, ‘...শঙ্খমুখরিত দেবালয়ে যে পূজার্থী আগত হইয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ কর। অস্তসূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নমাজ পড়িয়া উঠিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ কর। তোমাদের সম্মিলিত হৃদয়ের, বন্দে মাতরম গীতধ্বনি এক প্রান্ত হইতে আর এক প্রান্তে পরিব্যাপ্ত হইয়া যাক।’ আর গাইলেন, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল...।’

    রবি ঠাকুর সর্বদাই জাতি-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে বাংলাকে এক রাখার পক্ষে ছিলেন। তাই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রয়োজনে লিখেছিলেন স্বদেশি গান... ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘আমি ভয় করব না ভয় করব না’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’র মতো গান। এসব গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ মহাত্মা গান্ধীকে এতখানি আনন্দ দিয়েছিল যে, তিনি বাংলা শিখে ওই গান গাইতে গাইতে উপাসনা সভায় যোগ দিতেন। বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় বাংলাজুড়ে বিরাট গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। নতি স্বীকার করে ব্রিটিশ সরকার। লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হন।

    রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ ও উদার জাতীয়তাবাদকে কোনও স্বৈরাচারী শাসকই মেনে নিতে পারেননি। হিটলারকে দিয়ে সেই ধারার সূচনা। হিটলারের জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথের লেখা ও ছবি ‘নিষিদ্ধ’ হয়। ছয়ের দশকে রবীন্দ্রনাথের গান ‘ব্যান’ করে আয়ুব খানের পাকিস্তান। এমনকি ইমার্জেন্সির সময় ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ জাতীয় পঙক্তির উপর আরোপ হয় ‘সেন্সরশিপ’! অথচ ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী।

    ধর্মীয় বিভাজন আর জাতপাতের রাজনীতি আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বাঙালিকে বিভিন্ন ভাবে দাগিয়ে দেওয়ার এক ঘৃণ্য রাজনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে। যেকারণে আবারও বাঙলির একাত্ম হওয়া প্রয়োজন। আর প্রয়োজন রবি ঠাকুরের স্বদেশি গান। যে গান বলে ‘সবার উপর মানুষ সত্য’ আর তারও উপরে মানবিকতার কথা!

    • গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল

    • সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস 
  • Link to this news (বর্তমান)