• ‘অভিবাদন প্রিয়তম’, শতবর্ষে কলকাতার গ্লোব, ১০০ মোমবাতি জ্বলুক-কাটা হোক কেক
    বর্তমান | ২৩ নভেম্বর ২০২৫
  • কলহার মুখোপাধ্যায়, কলকাতা: কলকাতার যদি কোনও ডায়েরি থাকে তাহলে তাতে ২৩ নভেম্বর তারিখটি লাল কালি দিয়ে আলাদা করে চিহ্নিত করা আছে নিশ্চয়। এই দিনটিতেই কলকাতার অন্যতম গর্ব গ্লোব সিনেমা আত্মপ্রকাশ করে। হলিউডের একের পর এক ক্লাসিক। গ্রেগরি পেক থেকে অড্রে হেপবার্ন, সন কনোরি থেকে রিচার্ড বার্টন, গ্লোব তাবড় সব অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে কলকাতার। সেই গ্লোবও গিয়েছিল বন্ধ হয়ে। তারপর আবার খুলেছে। তবে ১০০ বছর কম সময় নয়। গ্লোব বদলে গিয়েছে আমূল। সেই উদার, বিস্তৃত, আভিজাত্যে টইটুম্বুর হলটি এখন তেমন নেই। তাকে সরিয়ে জায়গা নিয়েছে শপিং মল। তার মধ্য দিয়ে লিফটে উঠে তিন নম্বর বোতাম টিপলে পৌঁছে যাওয়া যাবে হলে। সেখানে দু’টি স্ক্রিনে সিনেমা চলে এখন।

    কলকাতার কবেকার চেনা গ্লোব পা দিল ১০০ বছরে। যদিও গ্লোব বিল্ডিংটির ইতিহাস আরও প্রাচীন। মূল কাঠের অপেরা হাউসটি ১৮৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত। নাম, বিজো গ্র্যান্ড অপেরা হাউজ। ১৯০৬ সালে অপেরা পরিবর্তিত হয় থিয়েটার হলে। তৎকালীন মালিক ই এইচ ডুকাসের থেকে কিনে নেন ইএম কোহেন। ১৯২০ সালে হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন। ১৯২২ সালে সিনেমা দেখানো শুরু। তার তিন বছর পর অর্থাৎ ১৯২৫ সালে নাম বদল। হল, গ্লোব সিনেমা। তখন কলকাতার ব্যাপারই আলাদা। আমেরিকার কুলীন সিনেমা পত্রিকায় পর্যন্ত বিজো গ্র্যান্ড অপেরা নিয়ে প্রকাশিত হয় প্রতিবেদন। কলকাতার প্রথম সারির যে সমস্ত হল ধারাবাহিকভাবে ইংরেজি সিনেমার স্ক্রিনিং করে গিয়েছে, গ্লোব তাদের মধ্যে অন্যতম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যালায়েড বাহিনীর যে ট্রুপ কলকাতায় ঘাঁটি গেড়েছিল তাদের বিনোদনের ব্যবস্থাও করেছিল গ্লোব। তখন হ্যাট-কোটদের ফিটন এসে থামত গেটের সামনে। ঘোড়াগুলি সওয়ারি নামিয়ে চিঁহি চিঁহি করে রাস্তার লোকজনকে ত্রস্ত করে চলে যেত। পিলে চমকাতে আবার আসত শো শেষে।

    আচ্ছা, তাঁর জন্মদিনে কি নিউ মার্কেট থেকে কিনে এনে ১০০ মোমবাতি জ্বালিয়ে কেক কাটা হবে? প্রিয়তম হলকে অভিবাদন জানাতে যাবে তো কলকাতা?

    রবিবারের অলস সকালে এলিটের উল্টোদিকের গলি দিয়ে ঢুকলে আমিনিয়া স্পেশাল আর বিরিয়ানির গন্ধ। একটু এগলে গন্ধটা পাল্টে কেক হয়ে যাবে। নিউ মার্কেটে ঢুকলে কেক গন্ধে মিশবে প্যাটিসের ওম, ক্যান্ডি আর কুকিজ আর নরম চিনি লজেন্সের নেশাসুবাস। মার্কেটের ও প্রান্তের গেট দিয়ে বেরলেই সামনে গ্লোব। আচ্ছা, কোহেন সাহেব কি জানতেন কলকাতার ল্যান্ডমার্ক হয়ে উঠবে তাঁর এই সিনেমা হল? তারপর কোনও একদিন, কোহেন কি জানতেন, তাঁর হলকে পাল্লা দিতে হবে ওটিটির সঙ্গে, তার আগে কেবল টিভি, ভিডিও পাইরেসির সঙ্গে। একসময় সিঙ্গল স্ক্রিনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কম্পিটিটর হিসেবে উঠে আসবে মাল্টিপ্লেক্স। জানতেন কি, সেই যুদ্ধ মরণপণ হবে? ১০০ বছর আগে নিশ্চয় আন্দাজ করতে পারেননি কোহেন। করলে কী দেখতে পেতেন তিনি? দেখতেন, তাঁর সাধের গ্লোব একদিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন তার কয়েকতলা জুড়ে শপিং মল। হল আবার চালু হয়েছে বটে, গ্লোব নামটিও অক্ষুন্ন বটে, তবে এ গ্লোব আর সে গ্লোব এক নয়। হাজার কিলো ব্রাহ্মী শাক খেলেও এখনকার গ্লোবে দাঁড়িয়ে তখনকার গ্লোবের ছবিটা স্মরণ করতে পারতেন না কোহেন। মনে হত জন্মান্তরের সীমান্তে দাঁড়িয়ে স্মৃতিবিভ্রমের এক রোগী। তার মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে মনের মধ্যে ফুটতে থাকা ১০০ বছরের একের পর এক ফ্ল্যাশব্যাক। তবু মন্দের ভালো। গ্লোব ফিরেছে। তার মতো ফিরে আসুক কলকাতার বাকি হলগুলিও। -নিজস্ব চিত্র
  • Link to this news (বর্তমান)