• পাঁকে-চক্রে ডুবে গিয়েছে আইন, প্রাণ রক্ষায় ভরসা শুধু আরশোলারা
    আনন্দবাজার | ২৩ নভেম্বর ২০২৫
  • ভিতরে বিষাক্ত কোনও গ্যাস জমে আছে কি? যে যন্ত্রের মাধ্যমে এটা জানা যায়, সেই যন্ত্র কেনাই হয়নি। ভরসা তাই আরশোলা!

    ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে পাঁক পরিষ্কার করতে নামার আগে তাই ভিতরে আরশোলা দেখা গেলেই শান্তি! কারণ, কোথাও মিথেন গ্যাস জমে থাকলে কোনও প্রাণীই সেখানে বাঁচতে পারে না। এর পরে আরশোলার ভরসাতেই এখনও মানুষ নামিয়ে দেওয়া হয়, কোথাও ৩০ ফুট, কোথাও আবার ৬০-৭০ ফুট গভীরে! তাতেই কোথাও বেঘোরে প্রাণ যায় মাটি কাটতে শহরে আসা শ্রমিকের। কোথাও বা পাঁকে তলিয়ে যান নির্মাণ ক্ষেত্রে কাজ পাওয়ার আশায় আসা কোনও শ্রমিক। অনেকেরই মতে, পাঁকে-চক্রে মানুষ মারার এই কাজকে ‘নরবলি’ ছাড়া আর কী-ই বা বলা যেতে পারে? তাঁদের দাবি, এই মৃত্যু-ফাঁদে কোনও শ্রমিক তলিয়ে গেলে দিনকয়েক শোরগোল চলে। মৃতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। কমিটি গঠন করে তদন্তের আশ্বাসও মেলে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই বদলায় না।

    চার বছর আগে কুঁদঘাটে মাটির নীচে কাজ করতে নামানো চার শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁদের পরিবারকে ৩০ লক্ষ টাকা করে এবং আহতদের পাঁচ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট। সেই সঙ্গে মানুষকে দিয়ে সমস্ত রকমের ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং’ (ম্যানহোল সাফাই, মল-মূত্র সাফাই বা বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজ) বন্ধ করাতে রাজ্য সরকারকে পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছে তারা। তার পরেও অবশ্য প্রশ্ন, এতেও কি পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে?

    অনেকেরই দাবি, ১৯৯৩ সালেই তো মানুষ নামিয়ে ম্যানহোল বা ভূগর্ভস্থ নালা পরিষ্কার নিষিদ্ধ হয়েছে। ২০১৩ সালে তৈরি হয়েছিল ‘প্রহিবিশন অব এমপ্লয়মেন্ট অ্যাজ় ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার্স অ্যান্ড দেয়ার রিহ্যাবিলিটেশন’ আইন। ২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট ক্ষতিপূরণের অঙ্কও বাড়িয়ে ৩০ লক্ষ টাকা করেছে। কিন্তু তার পরেও ম্যানহোলে মানুষ নামিয়ে কাজ করানো বন্ধ হয়নি। কুঁদঘাটের পরে একই ঘটনা ঘটেছে বানতলায়। সেখানে ম্যানহোলে নেমে পাঁকে তলিয়ে গিয়ে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। সেই ঘটনাতেও মৃতদের পরিবার সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ পায়নি বলে অভিযোগ। পুলিশ এবং পুরসভা ‘তদন্ত চলছে’ বলে দাবি করলেও ন’মাস পরেও জানা গেল না, সেই তদন্ত কত দূর এগিয়েছে।

    দেখা যাচ্ছে, একই অবস্থা কুঁদঘাটের ঘটনাতেও। কলকাতা হাই কোর্ট নগরপালকে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বললেও ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির ওই ঘটনায় সেই সময়েই একটি এফআইআর হয়েছিল। কিন্তু তার বেশি কিছুই এগোয়নি। পুরসভা, পূর্ত দফতর বা ঠিকাদার সংস্থার কাউকেই গ্রেফতার করা হয়নি। ঠিকাদার সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করা ছাড়া তেমন কোনও কঠোর পদক্ষেপই করা হয়নি বলে পুরসভা সূত্রের দাবি। আবার পুরসভার কর্মীরাই জানাচ্ছেন, সেই সময়ে নানা মহলের সমালোচনার মুখে তড়িঘড়ি তদন্ত কমিটি গড়ে পুরসভা। কিন্তু সেই কমিটি কী সিদ্ধান্তে পৌঁছল, তা এখনও সামনে আসেনি। উল্টে জানা গিয়েছে, ঠিকাদার সংস্থাকে ঘটনার ন’মাস পরেও কালো তালিকাভুক্ত করা যায়নি প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতায়। ওই কমিটি কয়েকটি সুপারিশ করেছিল। সেগুলির অধিকাংশই এখনও কার্যকর করা যায়নি। বদলে পুরসভা ‘গালিপিট ক্লেনজ়িং মেশিন’, ‘জেটি কাম সাকশন মেশিন’, ‘পাওয়ার বাকেট মেশিন’, ‘ম্যানহোল ডিসিল্টিং মেশিন’, ‘ব্লো ভ্যাক মেশিন’, ‘ওপেন নালা ডিসিল্টিং মেশিন’-সহ নানা ধরনের যন্ত্র কেনার দাবি করলেও ম্যানহোল পরিষ্কারের জন্য ব্রিটিশ আমলের ‘সুয়্যার ক্লেনজ়িং মজদুর’ পদটি এখনও রয়েছে। এখনও বহু পুরকর্মী কাজ করেন ওই পদে।

    তবে, শুধু কলকাতা নয়, দেশের নানা প্রান্ত থেকেই বার বার এই ধরনের ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে। হায়দরাবাদে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি চলাকালীনও ম্যানহোল পরিষ্কার করতে নেমে বিষাক্ত গ্যাসে চার জন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সংসদে এই সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে জানান, ২০১৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সেপটিক ট্যাঙ্ক বা ম্যানহোল সাফাইয়ের কাজ করতে গিয়ে ৪০০-র বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরে কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু এবং হায়দরাবাদের প্রধান নির্বাহী কর্তাদের কাছ থেকে হলফনামা চেয়েছিল শীর্ষ আদালত। ১৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হলফনামা দিয়ে ছয় শহরের প্রশাসনকে ‘ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং’ বন্ধ করার জন্য তারা কী কী পদক্ষেপ করেছে, জানাতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কলকাতা সেই হলফনামায় কী জানিয়েছে, সামনে আসেনি আজও।

    এ ব্যাপারে পরিবেশকর্মী নব দত্তের মন্তব্য, ‘‘আসলে কোনও আইন, আদেশকেই মান্যতা দেওয়া হয় না। ক্ষতিপূরণের টাকা সংশ্লিষ্ট অফিসারকে দায়বদ্ধ করে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে হয়তো এর পরে হুঁশ ফিরবে।’’
  • Link to this news (আনন্দবাজার)