এই সময়, বান্দোয়ান: মাকে তারা হারিয়েছে গত ভাদ্র মাসে। তিন মাসের ব্যবধানে পরিযায়ী শ্রমিক বাবাকে হারিয়ে রাতারাতি মাথার উপরে যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে তিন ভাইবোনের। বাড়ির বৃদ্ধ ঠাকুরদা-ঠাকুমা ভেবে কূল পাচ্ছেন না, তাঁরা কী করবেন। পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের কুঁড়িয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা দীনবন্ধু সিংয়ের মৃত্যু হয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশের আনন্দপুরমের কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে। গত মঙ্গলবার ওই রাজ্যেরই নান্দিয়াল স্টেশনের কাছে রেললাইনের পাশে দীনবন্ধুর দেহ পাওয়া যায়।
বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী ভারতী ও তিন ছেলেমেয়েকে নিয়েই ছিল দীনবন্ধুর সংসার। জঙ্গলের সম্পদ সংগ্রহ করে তা বেচে সংসার চলছিল না। বাধ্য হয়েই এলাকার পরিচিতদের সঙ্গে ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে অন্ধ্রপ্রদেশে গিয়েছিলেন তিনি। গত ভাদ্র মাসে বাড়িতেই স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। খবর পেয়ে আনন্দপুরম থেকে গ্রামে ফিরেছিলেন দীনবন্ধু। তবে তার আগেই নিভে গিয়েছিল স্ত্রীর জীবনদীপ। শেষ দেখাটুকুও হয়নি।
স্ত্রীর পারলৌকিক কাজকর্ম শেষ করে সপ্তাহ দুয়েক আগে তিন সন্তানকে বৃদ্ধ মা-বাবার কাছে রেখে ফের তিনি গিয়েছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশে। সেখানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তরুণ বলল, 'এলাকারই বাসিন্দা এক পরিযায়ী শ্রমিকের সঙ্গে ট্রেন ধরে বাবা বাড়ি ফিরছিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে তিনি দেখেন, বাবা ট্রেনে নেই। পরে রেললাইনের পাশ থেকে দেহ উদ্ধার হয়।' বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে দেহ গ্রামে ফিরিয়ে আনতে অন্ধ্রপ্রদেশে পৌঁছেছে তরুণ। ফোনে তরুণ জানিয়েছে, সেখানেই বাবার দেহ সৎকার করে বাড়ি ফিরবে। কেননা বাবার দেহ গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো অর্থ তাঁদের কাছে নেই।
এ দিকে, দীনবন্ধুর বৃদ্ধ বাবা গোষ্ঠ সিং ও বৃদ্ধা মা বাসন্তী দেবীর কাছেই রয়েছে দীনবন্ধুর বাকি দুই সন্তান, বছর ১৫-র সুমিত্রা ও বছর ১১-র দেবরাজ। অভাবের জেরে তরুণ ও সুমিত্রাকে লেখাপড়ায় ইতি টানতে হয়েছে। বাড়িতে মাঝেমধ্যেই বাবার জন্য কেঁদে উঠছে দেবরাজ। বাবার মৃত্যুর খবর সেই বালককে জানানো না-হলেও বাড়ির শোকার্ত পরিবেশ দেখে সে বুঝেছে, পরিবারে ঘটেছে অঘটন। বেলপাহাড়ি থেকে আসা পিসিমা কমলা সান্ত্বনা দিচ্ছেন বালককে। গোষ্ঠ ও বাসন্তী আরও বললেন, 'আমাদের একমাত্র রোজগারের ছেলেটাকেই তো ঈশ্বর কেড়ে নিল। আমরা কী ভাবে বাঁচব? কেই বা ছোট ছেলেমেয়েদের মানুষ করবে?'
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্য সরকারের পরিযায়ী শ্রমিক কল্যাণ প্রকল্পে দীনবন্ধু নাম লেখাতে পারেননি। দুয়ারে সরকার কর্মসূচির সময়ে তিনি ভিন রাজ্যে ছিলেন। তবে ঘটনা শুনে বান্দোয়ানের বিধায়ক রাজীবলোচন সরেন বলেছেন, 'আমরা ওই পরিবারের পাশে রয়েছি।' যে সংগঠন পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকারের দাবিতে কাজ করছে, সেই জঙ্গল মহল স্বরাজ মোর্চার কেন্দ্রীয় সভাপতি অশোক মাহাতো বলেন, 'এই পরিবারের পাশে যাতে রাজ্য সরকার দাঁড়ায়, সেই আবেদন জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখব।'