চার দশকের শূন্যতা মুছেছেন শিক্ষিকারা, কলাভবনে ঐতিহ্যের ছোঁয়া
আনন্দবাজার | ২৪ নভেম্বর ২০২৫
কলাভবনে ফিরছে গৌরী ভঞ্জ, যমুনা সেনদের ঐতিহ্য। সুকুমারী দেবী, চিত্রনিভা চৌধুরীদের হাত ধরে কলাভবনে মহিলা শিক্ষিকাদের যে ঐতিহ্য তৈরি হয়ে ছিল, তা মাঝের একটা দীর্ঘ সময় অনুপস্থিত ছিল। তবে এখন ফের পাঁচ শিক্ষিকার সমাবেশে ফিরছে সেই ঐতিহ্য। প্রাক্তন পড়ুয়ারা জানাচ্ছেন, একটা অভাববোধ ছিল, তবে গুরুপত্নীরা অর্থাৎ তৎকালীন অধ্যাপকদের স্ত্রী’রা সেই অভাব অনেকটাই পূরণ করে দিতেন। তবে শিক্ষিকাদের আগমনে ভবনের ভারসাম্য আরও সুনিশ্চিত হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কলাভবন। পাশ্চাত্য ও দেশীয় শিল্পরীতির চর্চা ও চর্যাই ছিল কলাভবন প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। ভবন প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পরেই ১৯২৪ সাল নাগাদ সুকুমারী দেবী সেখানে শিক্ষিকা হিসাবে যোগদান করেন। বাল্যবিধবা সুকুমারী দেবী বয়ন শিল্প এবং আলপনা অঙ্কনে বিশেষ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তাঁরই ছাত্রী ছিলেন চিত্রনিভা চৌধুরী। শান্তিনিকেতনের কলাভবনে পড়াশোনার শেষে সেখানেই অধ্যাপিকা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন চিত্রনিভা। অঙ্কন, আলপনা-সহ শিল্পের প্রায় প্রতিটি পথেই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। নন্দলাল বসুর দুই সুযোগ্যা কন্যা গৌরী ভঞ্জ এবং যমুনা সেন ছিলেন চিত্রনিভার ছাত্রী৷ পরবর্তীতে কলাভবনে একটা দীর্ঘ সময় অধ্যাপিকার দায়িত্ব সামলেছেন গৌরী ও যমুনা।
সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে গৌরী ও যমুনার অবসর গ্রহণের পর প্রায় চার দশক কোনও মহিলা শিক্ষিকা ছিলেন না শান্তিনিকেতনে। মাঝে নব্বইয়ের দশকে সোহিনী ধর কয়েক মাসের জন্য কলাভবনে অধ্যাপক হিসাবে কাজে যোগ দিলেও পরে তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। ফলে চিত্রনিভা, গৌরী, যমুনাদের ঐতিহ্যবাহী কলাভবন একটা দীর্ঘ সময় মহিলা শিক্ষকের অভাব বোধ করেছে। তবে সেই অভাব মিটেছে ২০১২ সালে। কলাভবনের চিত্রকলা বিভাগে অধ্যাপিকার পদে যোগ দেন ধরিত্রী বোরো। এরপর একে একে মেঘালি গোস্বামী (শিল্পের ইতিহাস), ভাবনা খাজুরিয়া বসুমাতারি, অর্চনা দাস (সেরামিক্স অ্যান্ড গ্রাফিক ডিজাইন) এবং বনতন্বী দাস মহাপাত্র (টেক্সটাইল) কলাভবনে যোগ দেন। মহিলা শিক্ষকের যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিল কলাভবনে তা এখন নেই বলে জানাচ্ছেন বিশ্বভারতীর আধিকারিকেরা।
কলাভবনের প্রাক্তন ছাত্র তথা কলাভবন সংগ্রহশালার অবসরপ্রাপ্ত অবেক্ষক (কিউরেটর) সুশোভন অধিকারী বলেন, ‘‘আমরা যে সময় কলাভবনে পড়েছি, (১৯৭৫-৮২) তখন কোনও শিক্ষিকা ছিলেন না। আমাদের মাঝে মাঝেই মনে হত শিক্ষিকা থাকলে বেশ ভাল হত। মহিলা ছাত্রীদের কিছু কিছু সুবিধা অসুবিধা থাকে, সেগুলো আলোচনার জন্য কাউকে পেলে হয়তো ভালই হত।’’ সেই সঙ্গেই সুশোভন বলছেন, ‘‘আমাদের সময় বিভাগে খুব বেশি পদ ছিল না। যে কয়েকটি পদ ছিল, তার সবই পূর্ণ ছিল। আর তখন যাঁরা অধ্যাপক ছিলেন, তাঁদের পরিবারও ভবনের সঙ্গে অত্যন্ত সম্পৃক্ত থাকতেন। তাই ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অধ্যাপিকার অভাব তৎকালীন অধ্যাপকদের স্ত্রী’রাও অনেকটা পূরণ করতেন।’’
কলাভবনের প্রাক্তন ছাত্রী তথা বর্তমান শিক্ষিকা বনতন্বী দাস মহাপাত্র বলেন, ‘‘আমি যখন ছাত্রী ছিলাম (২০০১-০৮), তখনও কোনও অধ্যাপিকাকে আমরা পাইনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা এই অভাব বোধ করতাম। অধ্যাপিকা থাকলে ছাত্র-ছাত্রীদের আলোচনার পরিসর অনেকটাই বড় হয়ে যায়।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের ছাত্রাবস্থাতেও শিক্ষকদের স্ত্রীরা অনেক সম্পৃক্ত থাকতেন, তবে তা ধীরে ধীরে কমেছে। সেক্ষেত্রে আমাদের মতো শিক্ষিকারা থাকলে সকলের জন্যই হয়তো ভাল হয়। শুধু পড়াশোনার জন্য নয়, বরং সর্বাঙ্গীন জীবন শিক্ষার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি শুরুত্বপূর্ণ।’’
কলাভবনের অধ্যক্ষ শিশির কুমার সাহানা বলছেন, ‘‘কিছুটা শূন্যস্থান হয়তো তৈরি হয়েছিল, কিন্তু ২০১২ সাল থেকে একে একে পাঁচ জন শিক্ষিকা ভবনে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। ফলে কোনও শূন্যস্থান যদি থেকেও থাকে, সেটা এখন আর নেই।’’