সিভিক ভলান্টিয়ারদের প্রশিক্ষণ দিতে উদ্যোগ নিয়ে রাজ্য প্রশাসন। সিভিকদের হাতেকলমে শেখানো হবে কী করতে হবে এবং কী করতে হবে না। তবে কী করা উচিত নয় সে বিষয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে বলে খবর। উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ এবং পশ্চিমাঞ্চলে প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছে।
ব্যারাকপুরের চারটি জায়গায় ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। সেখানে হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগনা, হুগলি এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন পুলিশ জেলা ও কমিশনারেটের অধীনে কর্মরত সিভিক ভলান্টিয়ারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কৃষ্ণনগরের সশস্ত্র পুলিশের নবম ব্যাটেলিয়নে প্রশিক্ষণ হবে নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদের সিভিকদের।
পূর্ব মেদিনীপুরের সালুয়ায় তিনটি জায়গায় ভাগ করে হবে প্রশিক্ষণ শিবির। এখানে ঝাড়গ্রাম, হাওড়া গ্রামীণ, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, হুগলি গ্রামীণ জেলা পুলিশ, হাওড়া ও খড়্গপুর জিআরপি-র অধীনে থাকা সিভিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ ছাড়া বরজোড়া, আসানসোল, পুরুলিয়া, দুর্গাপুর এবং বীরভূমের রাজনগরে প্রশিক্ষণ হবে সংশ্লিষ্ট জেলা ও কমিশনারেটের সিভিক ভলান্টিয়ারদের।
উত্তববঙ্গের সিভিকদের জন্যও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে সশস্ত্র পুলিশের চতুর্থ ব্যাটেলিয়নে প্রশিক্ষণ চলবে মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুর, রায়গঞ্জ এবং ইসলামপুর জেলা পুলিশের সিভিকদের। জলপাইগুড়ির দ্বাদশ ব্যাটেলিয়নে প্রশিক্ষণ হবে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহারের সিভিক ভলান্টিয়াররা। শিলিগুড়ি কমিশনারেট এবং কালিম্পং জেলা পুলিশের অধীনস্থ সিভিকদের প্রশিক্ষণ হবে ডাবগ্রামে। শিলিগুড়িতে র্যাফের দ্বিতীয় ব্যাটেলিয়নে হবে দার্জিলিংয়ের সিভিকদের প্রশিক্ষণ।
ডাবগ্রামে ইতিমধ্যেই কিছু পুলিশ জেলা এবং কমিশনারেটের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের সিভিক থেকে আইবির অধীনে থাকা সিভিকরা এই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে খবর। পাঁচ দিন ধরে চলছে প্রশিক্ষণ। রাজ্য পুলিশের এডিজি (ট্রেনিং)-এর তরফে সব জেলার পুলিশ এবং পুলিশ কমিশনারদের একটি বার্তা পাঠানো হয়েছে।
সেই বার্তায় কোন জেলা বা কমিশনারেটের অন্তর্গত কত জন সিভিককে প্রশিক্ষণে পাঠাতে হবে তার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় আট হাজারের বেশি সিভিক ভলান্টিয়ারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কলকাতা পুলিশের অধীনে থাকা সিভিকরা আপাতত এই প্রশিক্ষণ নিচ্ছে না বলে জানা গিয়েছে। মহিলা সিভিকদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে কোনও নির্দেশিকা জারি করেনি ভবানী ভবন।
শারীরিক কসরত তো থাকছেই। সেই সঙ্গে আইনের বিষয়ে অবগত করানো হচ্ছে সিভিকদের। পাশাপাশি আচার-ব্যবহার থেকে কথাবার্তা ঠিক করে বলতেও শেখানো হচ্ছে ট্রেনিং-এ। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তার সঙ্গে একজন সিভিকের আদব-কায়দা কেমন হবে তাও হাতেকলমে শেখানো হচ্ছে এই প্রশিক্ষণ শিবিরে। সাধারণ মানুষ, পথচারী, গাড়ির চালকদের সঙ্গে যাতে কোনও ভাবেই খারাপ ব্যবহার করা না হয় তাও প্রশিক্ষণে শেখানো হচ্ছে বলে খবর।
প্রশিক্ষণ নেওয়া একাধিক সিভিকদের থেকে জানা গিয়েছে, পুলিশের ‘সহকারী’ হিসেবেই কাজ করতে হবে বলে তাঁদের জানানো হয়েছে। রাস্তায় গাড়ির ধরলে গাড়ির কোনও কাগজপত্র সিভিকরা নিতে পারবেন না বলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সিভিকদের এক্তিয়ার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করানো হচ্ছে এই প্রশিক্ষণ শিবিরগুলিতে। কলকাতা হাইকোর্ট দেড় বছর আগে সিভিকদের ক্ষমতা সম্পর্কে যে নির্দেশকা দিয়েছিল, প্রশিক্ষণে সে বিষয়ে তাঁদের ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অতীতে এই ধরনের প্রশিক্ষণ বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু কিছু থানা এলাকায় হয়েছে। রাজ্য জুড়ে কেন্দ্রীয় ভাবে এমন উদ্যোগ কখনও দেখা যায়নি। তেমনই জানাচ্ছেন পুলিশ কর্তারা।
তবে সিভিক ভলান্টিয়ারদের এই প্রশিক্ষণ ঘিরে তৈরি হয়েছে একাধিক প্রশ্ন। ভোটের ঠিক আগেই কেন এই প্রশিক্ষণ শিবির তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সিভিকদের দিয়ে অন্য কোনও পরিকল্পনা রয়েছে কি না সে দিকেও নজর রয়েছে অনেকের। তবে পুলিশের একাংশ মনে করছেন, সিভিকেরা সরাসরি বাহিনীর অংশ না-হলেও তাঁরা বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে প্রত্যেকেরই ন্যূনতম প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। সেটাই করা হচ্ছে। আবার অন্য অংশ মনে করছেন, এই পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ হয় না। পুরোটাই আসলে ‘আইওয়াশ’।
গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ঘটনায় সিভিকদের নাম উঠে এসেছে। তোলাবাজি থেকে সাধারণ নাগরিককে রাস্তায় পেটানোর ঘটনায় নাম জড়িয়েছে সিভিক ভলান্টিয়ারদের। তবে আরজি কর কাণ্ডে সঞ্জয় রায় নামে এক সিভিক ভলান্টিয়ারের নাম জড়ানোয় আগুনে ঘি ঢালে। সিভিকদের আইন ভাঙা ও দাদাগিরির দিকটি আরও প্রকটভাবে সামনে আসে। রাজ্যের বিরোধী দলগুলি সিভিকদের বড় অংশকে ‘শাসকদলের ভাড়াটে বাহিনী’ বলে তোপ দাগে।
গত কয়েক বছর ধরে গ্রাম, মফস্বল, ক্রীড়াক্ষেত্র থেকে বহু তরুণকে সিভিকে নিয়ো করেছে পুলিশ। পর পর একাধিক ঘটনায় সিভিকদের ভাবমূর্তিও অনেকটাই নষ্ট হয়েছে। সেই ভাবমূর্তি উদ্ধার করতেই এই প্রশিক্ষণ বলে অনেকেই মনে করছেন। তবে বিধানসভা ভোটের আগে সিভিক ভলান্টিয়ারদের প্রশিক্ষণ যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ।