১৯৬০-এর ২৫ নভেম্বর ডমিনিকান রিপাবলিকে হত্যা হয় তিন সহোদরার— পাত্রিয়া মিরাবাল, মারিয়া মিরাবাল এবং আন্তোনিয়া মিরাবাল। মানবাধিকার সচেতন এই মিরাবাল বোনেরা লড়েছিলেন শাসক রাফায়েল ত্রুখিয়ো-র একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে। রাফায়েলের নির্দেশেই এঁদের হত্যা। ১৯৯৯-র ১৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জে সিদ্ধান্ত হয় ২৫ নভেম্বর পালিত হবে ‘নারীর উপর হিংসার প্রতিকারের দাবিতে আন্তর্জাতিক দিবস’ হিসাবে। সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে দিনটিকে কেন্দ্র করে জনসচেতনতা প্রসারের চেষ্টা করা হয় যাতে লিঙ্গবৈষম্যের সমস্ত উপসর্গ থেকে সমাজকে মুক্ত করা যায় এবং প্রত্যেক নারী প্রাপ্য মানবাধিকার নিয়ে সম্মানের সঙ্গে সুস্থ ভাবে বাঁচেন। এর জন্য যে শোষণের আবর্জনাগুলি থেকে সমাজকে মুক্ত করা দরকার তাতে নবতম সংযোজন ‘ডিজিটাল হিংসা’।
প্রযুক্তি উন্নত হলে সভ্যতার উন্নতি হয় যেমন সত্যি, নারীর বিপন্নতা তেমনই বাড়ে, সেও একই রকম সত্যি। কাজেই ২০২৫-এ নারীর উপর হিংসা বন্ধ করার ডাক দিতে হলে স্লোগান তুলতেই হবে— “মহিলা ও বালিকাদের উপর ডিজিটাল হিংসার বিরুদ্ধে এক হও।” ডিজিটাল হিংসার নানা প্রকার। উদ্দেশ্য একই। মেয়েদের উপর অভব্য ভাবে নজর রাখা, অনুসরণ, হয়রান করা, তাঁদের সঙ্গে অপব্যবহার করা। ডিজিটাল হিংসা মহিলা, এমনকি বালিকাকেও এমন নারকীয় অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে যে সে সমাজে একঘরে হয়ে যায়; অনেক সময় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। ডিজিটাল পদ্ধতির সুযোগে অনুমতি বিনা নারীর নগ্ন ছবি তোলা হয়। ট্রোলিং থেকে শুরু করে ভয় দেখানো, গুন্ডামিও চলে। অনলাইনে যৌন হেনস্থা এখন জলভাত। কৃত্রিম মেধার সাহায্যে ছবি, অডিয়ো, ভিডিয়ো বিকৃত করে ভাইরাল করা হয়। ঘৃণা ভাষণের মাধ্যমে চরিত্র হননের অপচেষ্টা, ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেল করা হয়। ভুয়ো প্রোফাইল বানিয়ে ঠকানো হয়। নারী বিদ্বেষের বার্তা প্রচারিত হয় বিনা বাধায়।
কালের অদ্ভুত পরিহাস এই যে সামন্ততন্ত্র, পুরুষতন্ত্র ইত্যাদির সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য আশীর্বাদের মতো অবতীর্ণ যে বিজ্ঞান চেতনা, সেও দমিত হচ্ছে বৈষম্যের পায়ের নীচে। প্রযুক্তি নারীকে নিরাপত্তা না দিয়ে নরকে ঠেলছে। এমনিতেই ভ্রূণ হত্যা থেকে শিশুমৃত্যু, স্কুলছুট থেকে বাল্যবিবাহ, শিশু-মায়ের আর্তনাদ থেকে পণের জন্য হত্যা বা আত্মহত্যা আমাদের অস্থির রাখে। তার উপর এখন বায়ুতরঙ্গেও ভাসছে হিংসার বিষ। আজকের আধুনিক কিশোরী বা তরুণী মাত্রেই ডিজিটাল হিংসার আয়ত্তের মধ্যে ঘোরাফেরা করেন। তাঁদের মধ্যে আবার কিছু জনের ঝুঁকি তালিকার উপর দিকে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন যাঁরা নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরিতে সচেষ্ট। কেউ রাজনীতিক, সমাজকর্মী, বা মানবাধিকার আন্দোলনের শরিক, সাংবাদিক, চেহারায় আকর্ষণীয়, অভিবাসী, বিশেষ ভাবে সক্ষম, বা সংখ্যালঘু। মোট কথা, ডিজিটাল দুনিয়ার অনেকটা জুড়ে বসে গিয়েছে খাপ পঞ্চায়েত আর অনলাইনচারী স্বনিযুক্ত জ্যাঠামশাইরা ফতোয়া জারির জবরদস্তি শুরু করে দিয়েছেন। নারী যেন স্ক্রিনের বাইরে, ভিতরে কোথাও নিরাপদ না থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেই দিয়েছে, বিশ্বের প্রতি তিন নারীর এক জন শারীরিক বা যৌন হেনস্থার শিকার। অনলাইন দুনিয়াই বা দূরে থাকে কেন? ডিজিটাল পরিসরে ঘোরাফেরা করা নারীদের ৩৮%-ই নিজে ডিজিটাল হিংসার শিকার হয়েছেন, ৮৫% অন্য নারীকে হতে দেখেছেন। অশালীন ছবির মধ্যে সিংহভাগই নারীর এবং অনুমতি ছাড়াই তৈরি। ১৫ বা তার বেশি বয়সের প্রতি দশ জন মেয়ের এক জন ডিজিটাল হিংসা দ্বারা নির্যাতিত। নারী সাংবাদিকদের ৭৩%-এরই এমন হিংসার অভিজ্ঞতা আছে। ইউরোপে পার্লামেন্টের নারী সদস্যদের ৫৮% ডিজিটাল নির্যাতনের কোপে পড়েন। ভারতেও ভয়াবহ চিত্র। ২০১৮-২২’এ ভারতীয় মেয়েদের উপর ডিজিটাল হিংসা দ্বিগুণ হয়েছিল। অনলাইনে যৌন হেনস্থার শিকার হন বিরাট সংখ্যক নারী। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো জানিয়েছে দেশের ৯৮% সাইবার অপরাধই মহিলাদের বিরুদ্ধে। অবশ্য যে দেশ মহাকাশের যুগে দাঁড়িয়েও সদ্যোজাত শিশুকন্যার মুখে বালি গুঁজে দেয়, তার কাছে কী-ই বা আশা করা যায়?
একটি দিন বা একটি সপ্তাহে কিছু সভা করলে, ক’টা স্লোগান তুললে, খানকয় প্রবন্ধ লিখলে মেয়েরা ডিজিটাল হিংসা থেকে পরিত্রাণ পাবেন, এমন নয়। কিন্তু ক্যালেন্ডারে একটি বিশেষ তারিখ বিশেষ মর্মে চিহ্নিত হলে মানুষের স্মৃতি আর কর্তব্যজ্ঞান খানিক নাড়া খায়। সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলিকে সক্রিয় প্রতিরোধে উদ্যোগী হতে বলা দরকার। সমস্ত দেশে ডিজিটাল হিংসার বিরুদ্ধে কড়া আইন প্রণয়ন ও তার যথার্থ প্রয়োগ দরকার। অনলাইন দুনিয়া সম্পর্কে মহিলাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। বিদ্যালয় স্তর থেকে শিশুদের ডিজিটাল পৃথিবী ও তার বিপদ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া দরকার। সবচেয়ে বেশি দরকার ‘পুরুষ’ শব্দের ঠিক অর্থ পুরুষদের বোঝানো যা নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসাবে দেখার দর্শনকে সমর্থন করে না। মুশকিল হল চাহিদা-জোগানের লেখচিত্র অন্তত এই জটিল ক্ষেত্রে ভারসাম্য-বিন্দুর দেখা পাবে কি না, জানা নেই। তবু নারীর জন্য অনলাইন দুনিয়াকে নিরাপদ করার চেষ্টা জরুরি।