• মূলচক্রীরা আজও মুক্ত, ১৬৬ জনের আর্তনাদ ভাসে মুম্বইয়ের বাতাসে, ফিরে দেখা ২৬/১১
    এই সময় | ২৬ নভেম্বর ২০২৫
  • স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে অন্যতম অভিশপ্ত দিন। মায়ানগরীর বুকে ১৬৬ জনকে ঠান্ডা মাথায় খুন করে পাকিস্তানের ১০ জঙ্গি। ভারতীয় নাগরিকদের নিরাপত্তা বড়সড় প্রশ্নের মুখে পড়ে যায় ২৬/১১-র জঙ্গি হামলার পরে। সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার পরে ১৭ বছর অতিক্রান্ত। আরব সাগর দিয়ে বহু জল অতিবাহিত। তবে হত্যালীলার সেই ছবি আজও মনে রয়েছে প্রতিটি ভারতীয়ের মনে। ফিরে দেখা যাক সেই ঘটনার পর্যায়ক্রম।

    লস্কর-ই-তৈবার কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ১০ জঙ্গিকে। মোট চার দফা ট্রেনিং হয়। প্রশিক্ষণ দেয় লস্করের শীর্ষ নেতৃত্ব। ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেয় ১০ প্রশিক্ষিত জঙ্গি। প্রথমে ৭ নভেম্বর হামলার ছক করেছিল জঙ্গিরা। আরব সাগর পেরিয়ে মুম্বইয়ে ঢুকতে একটি ভারতীয় নৌকাকে ব্যবহার করার প্ল্যান করে জঙ্গিরা। সেই নৌকার মালিক শেষ পর্যন্ত রাজি না হওয়ায় এক মৎস্যজীবীর ডিঙিতে করে ভারতের বাণিজ্য নগরীতে পা রাখে জঙ্গিরা।

    মুম্বইয়ে পা রাখার পরে এক মুহূর্ত দেরি করেনি। টিম ভাগ করে ছড়িয়ে পড়ে ছ’টি জায়গায় ১০ জনের টিম। প্রথমে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ টার্মিনাস রেল স্টেশনে হামলা চালায় ইসমাইল খান ও আজমল কাসভ। এর পরে এক এক করে কামা হাসপাতাল, লিওপল্ড ক্যাফে, মুম্বইয়ের তাজ হোটেল এবং ওবেরয় রিসর্টের সদর দপ্তর, নরিম্যান হাউসে হামলা হয়। মুম্বইয়ের বাতাসে তখন শুধুই বারুদের গন্ধ। কান ফাটা আর্তনাদ, রক্তে ভাসছে মেট্রো সিটির রাস্তা। জঙ্গিদের খতম করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুম্বই পুলিশ।

    প্রশিক্ষিত জঙ্গিদের সঙ্গে প্রাণের বাজি রেখে লড়েছিলেন মুম্বই পুলিশের টিম। তাঁদের সঙ্গে নামানো হয় NSG টিম। দিল্লি থেকে এয়ার লিফ্ট করে মুম্বইয়ে পৌঁছয় NSG কমান্ডোর টিম। শুরু হয় ‘অপারেশন ব্ল্যাক টর্নেডো’। নরিম্যান হাউস, হোটেল তাজ এবং হোটেল ট্রাইডেন্ট - ওবেরয়ে প্রবেশ করে NSG টিম। নরিম্যান হাউসে কপ্টার থেকে নামে NSG কমান্ডো। NSG টিম এবং মুম্বই পুলিশের সঙ্গে প্রায় ৬০ ঘণ্টা গুলির লড়াই চলে জঙ্গিদের। এক এক করে সব জঙ্গিকে খতম করা হয়। জীবিত অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয় আজমল কাসভকে। ২৭ তারিখই কাসভকে ধরে ফেলে NSG।

    আর্থার রোড সেন্ট্রাল জেলে কড়া নিরাপত্তাক মধ্যে রাখা হয় আজমল কাসভকে। এক বছর ধরে জেরার পরে ২০০৯ সালে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অপরাধ কবুল করে কাসভ। ২৬/১১-র মামলা চলাকালীন আমেরিকার শিকাগোয় গ্রেপ্তার করা হয় পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ডবল এজেন্ট ডেভিড কোলম্যান হেডলি। এই হামলার অন্যতম মূলচক্রী হেডলি। হামলার আগে মুম্বই-সহ ভারতের বিভিন্ন শহর ঘুরে করে গিয়েছিল। তদন্তে জানা যায়, তাজ হোটেলে রাতও কাটিয়ে গিয়েছিল হেডলি।

    ২০১০ সালে কাসভকে প্রথম ফাঁসির সাজা দেয় ট্রায়াল কোর্ট। পরে বোম্বে হাইকোর্ট ২০১১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সাজা বহাল রাখে। সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় কাসভ। ২০১২ সালের ২৯ অগস্ট কাসভের ফাঁসির সাজা বহাল রাখে শীর্ষ আদালত। মহারাষ্ট্র সরকারের মাধ্যমে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করে কাসভ। কিন্তু সেটাও খারিজ হয়ে যায়। ২১ নভেম্বর কাসভকে পুনের ইয়েরওয়াড়া জেলে ফাঁসি দেওয়া হয়। কবর দেওয়া হয় জেলের মধ্যেই।

    জঙ্গিদের পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ রয়েছে এমন বেশ কিছু নথি, ছবি, জঙ্গিদের ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট পেশ করে ভারত। পাকিস্তানের হাতে সেগুলি তুলেও দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি জঙ্গি জাকিউর রহমান লখভি এবং হাফিজ সৈয়দের নেতৃত্বেই এই জঙ্গি হামলা হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় তদন্তে। এই ঘটনার পরে পাকিস্তানে মোট সাত জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পাকিস্তান সন্ত্রাস দমন আইনে লস্কর জঙ্গি জাকিউর রহমান লকভিকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু তাকে ভারতের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করে পাকিস্তান। পরে জামিনে মুক্তিও দেওয়া হয় তাকে।

    ২০১৩ সালে ডেভিড হেডলিকে ৩৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় আমেরিকার আদালত। ২০১৫ সালে এই মামলায় ডেভিডকে রাজসাক্ষী করা হয়েছিল। মুম্বই আদালতে ভিডিয়ো কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে সাক্ষ্য দেয় হেডলি। চলতি বছরেই এই হামলার চক্রীদের অন্যতম হেডলির বন্ধু তাহাউর হুসেন রানাকে ভারতে নিয়ে আসা গিয়েছে। বর্তমানে NIA-এর হেফাজতে রয়েছে এই রানা।

    লস্কর-ই-তৈবার চিফ হাফিজ সৈয়দ, মুম্বই হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড জাকিউর রহমান লখভি, মেজর ইকবাল, আব্দুল রহমান হাসিম সৈয়দ ওরফে পাশা এখনও মুক্ত। এদের মধ্যে অনেকেই পাকিস্তানে বহাল তবিয়তে রয়েছে বলেও গোয়েন্দাদের তরফে দাবি করা হয়েছে।

  • Link to this news (এই সময়)