নিয়ম আছে। সরকারি বিজ্ঞপ্তিও জারি আছে। কিন্তু সেই নিয়ম বা বিজ্ঞপ্তি মানার বালাই কোথায়? বিধিভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাই বা নেওয়া হচ্ছে কোথায়? উল্টে কোথাও বৈধ নথিপত্র ছাড়াই চলতে থাকা পড়ুয়া বোঝাই, লজ্ঝড়ে স্কুলগাড়ি বাতিস্তম্ভে ধাক্কা মেরে উল্টে যাচ্ছে। কোথাও পড়ুয়া ভর্তি চলন্ত স্কুলগাড়িতে আগুন ধরে যাচ্ছে। অনেক সময়ে আবার স্কুলগাড়ির বিরুদ্ধে অন্য ‘ডিউটি ধরার’ তাড়ায় মাঝরাস্তায় পড়ুয়াদের গাড়ি বদল করানোর বা নামিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার অভিযোগও উঠছে। এর মধ্যেই হাওড়ার উলুবেড়িয়ায় স্কুলগাড়ি উল্টে জলে পড়ে তিন স্কুলফেরত পড়ুয়ার মৃত্যুর ঘটনায় নতুন করে প্রশ্ন উঠছে, আর কবে পরিস্থিতির বদল হবে?
সোমবার উলুবেড়িয়ার ওই ঘটনায় অনেকেরই মনে পড়ছে পাঁচ বছর আগের হুগলির পোলবার ঘটনার কথা। সে দিনও পড়ুয়া বোঝাইস্কুলগাড়ি দিল্লি রোডের ধারে নয়ানজুলিতে উল্টে যায়। গুরুতর জখম দ্বিতীয় শ্রেণির এক পড়ুয়ার এসএসকেএম হাসপাতালে মৃত্যু হয়। ঘটনায় রাজ্য জুড়ে শোরগোল পড়ে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জেলায় জেলায় স্কুলগাড়িগুলির অবস্থা যাচাইয়ের নির্দেশদেন। কিন্তু তাতেও কাজের কাজ যে হয়নি, তা উলুবেড়িয়ার ওই দিনের ঘটনাতেই ফের স্পষ্ট বলে মত অনেকের।
দিনকয়েক আগেই কলকাতার এক বেসরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের নিয়ে গিয়ে মাঝপথে ছেড়ে চলে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল একটি স্কুলগাড়ির এক কর্মীর বিরুদ্ধে। দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা খুদেরা স্কুলে ফিরে কান্নাকাটি শুরু করে। প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে অন্য গাড়িতে তুলে তাদের বাড়ি পাঠানো হয়। এ নিয়ে বিতর্ক হলেও ওই স্কুলগাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে স্কুলের তরফে কোনও কড়া পদক্ষেপই করা হয়নি বলে অভিযোগ। তবে এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। এ শহরেই স্কুলগাড়ির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রচুর। অভিভাবকদের দাবি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের নেশা স্কুলগাড়ি মালিকদের বেআইনি কার্যকলাপের দিকে ঠেলে দেয়। নিয়ম হল, স্কুলগাড়িতে ঠাসাঠাসি করে ছাত্রছাত্রীদের নিয়েযাওয়া যাবে না। কিন্তু অভিযোগ, সরকারি ওই নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গাড়িতে ঠাসাঠাসি করেই তোলা হয় পড়ুয়াদের। একটি গাড়ি একাধিক স্কুলের জন্যখাটানো হয়। ফলে কোনও রকমে বাচ্চাদের গাড়িতে তুলে, বেপরোয়া ভাবে চালিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েই ফের সেটি রওনা হয় নতুন স্কুলের উদ্দেশে।
এ ছাড়াও ব্যক্তিগত মালিকানার কাগজে স্কুলগাড়ি চালানো, স্পিড লিমিট ডিটেক্টর (এসএলডি) না থাকা বা খারাপ হয়ে যাওয়া, চালকের বৈধ লাইসেন্স না থাকার মতো অভিযোগ তো রয়েছেই। চালকদের কাছেসংশ্লিষ্ট স্কুলগাড়ির মালিকের কোনও ‘অথরাইজেশন’ শংসাপত্রও দেখতে পাওয়া যায় না। গাড়িতে প্রাথমিক চিকিৎসার কোনও বাক্স থাকে না। বহু গাড়ির চাকা চলাচলের উপযুক্তও হয় না।
জেলায় জেলায় পরিস্থিতি আরও খারাপ বলে অভিযোগ। উলুবেড়িয়ার ঘটনায় যেমন তদন্তে উঠে আসছে, জলে পড়ে যাওয়া ২২ বছরের পুরনো ওই গাড়িটির ২০১৮ সাল থেকে রেজিস্ট্রেশন নেই। ফিটনেস শংসাপত্র, দূষণ সংক্রান্ত নথি, বিমার কাগজও নেই। ভুক্তভোগীদের দাবি, জেলায় জেলায় এ ভাবে পড়ুয়া আনা-নেওয়া রোজকার ব্যাপার। যে গাড়ি দিনে পড়ুয়া তুলতে স্কুলে যাচ্ছে, সেই গাড়িই বিকেলের পরে সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে। এমন অধিকাংশ গাড়িই রাস্তায় চলার অনুপযুক্ত। তাদের চাকার অবস্থা, স্টিয়ারিংয়ের পরিস্থিতি বিপজ্জনক।
পরিবহণ দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘প্রতিটি বাচ্চাকে সিট বেল্ট পরিয়ে বসানোর কথা। কিন্তু যে গাড়ির কোনও রেজিস্ট্রেশনই নেই, সেই গাড়ির আবার সিট বেল্ট!’’ জেলা পুলিশের এক কর্তার আবার বক্তব্য, ‘‘যে সব গাড়ি ব্যবহার হচ্ছে, তার অধিকাংশেরই কাটাইয়ে চলে যাওয়ার কথা। কাটাইয়ে দেওয়ার আগে জেলা, গ্রামে কিছুটা চালিয়ে নিয়ে টাকা কামানোর চেষ্টা চলছে। এমন গাড়ি জেলার বাজারে ১০-১৫ হাজার টাকাতেই পাওয়া যায়। এমন গাড়ির দূষণও প্রবল।’’
কিন্তু পুলিশ বা পরিবহণ দফতর দেখে না কেন? পুলিশের যুক্তি, ধরতে গেলে বাচ্চারা এত কান্নাকাটি করে যে, ছেড়ে দেওয়া হয়। পরিবহণ দফতরের কর্তাদের আবার দাবি, জেলায় জেলায় স্কুলগাড়ি দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো অত কর্মী কোথায়?
তা হলে উপায়? অবৈধ স্কুলগাড়ির চলাচল বন্ধের রাস্তা দেখাতে পারেন না কেউই।