রেড রোডে সংবিধান দিবসের অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে দেশের গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার, ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং নাগরিকত্ব সংকট নিয়ে কড়া মন্তব্য করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানান, আজ যখন গণতন্ত্র ও ধর্ম দুই-ই সঙ্কটের মুখে, তখন দেশের মানুষের নিজেদেরই ভাবতে হবে, ‘এখন কি নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে?’ তাঁর অভিযোগ, এই পরিস্থিতির নেপথ্যে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি প্রস্তুতির চেষ্টা স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ড. বিভূতিভূষণ রামজি আম্বেদকর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি যে অবিভক্ত বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, এই তথ্য দেশের অনেকেই জানেন না। এতে বাংলার গর্ব আরও বৃদ্ধি পায়। সেই ইতিহাসের উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজ যখন নাগরিকত্ব, ভোটাধিকার ও ধর্মীয় সমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তখন সংবিধানের মূল্যবোধকেই আঘাত করা হচ্ছে।
তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা আজ যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের দয়ার দান নয়। শহিদদের আত্মবলিদানের মাধ্যমেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। সেই শহিদদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন বাংলার মানুষ। পাঞ্জাবও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। বাংলাই দেশকে নবজাগরণ এনে দিয়েছে।’ মুখ্যমন্ত্রী তাঁর এই বক্তব্যের পর সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ পাঠ করেন এবং গণতন্ত্র রক্ষার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সংবাদমাধ্যমে তিনি দেখেছেন, সদনে ‘জয় হিন্দ’ ও ‘বন্দে মাতরম্’ বলতে নাকি বাধা দেওয়া হচ্ছে। যদিও বিষয়টি যাচাই করে দেখতে হবে। তাঁর প্রশ্ন, ‘কেউ কি বাংলার পরিচয় এইভাবে মুছতে চাইছে?’ তিনি জানান, বাংলা বরাবর গণতন্ত্র, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের পক্ষে লড়েছে এবং ভবিষ্যতেও লড়বে।
সিএএ ও এসআইআর–সংক্রান্ত অস্থিরতার প্রসঙ্গ টেনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, নাগরিকত্ব ইস্যুতে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বনগাঁর অনুষ্ঠানে ঢাক বাজাতে থাকা শিল্পীর কান্না তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। বিহারে বাড়িঘর ভাঙার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি অভিযোগ করেন, ভোট-পরবর্তী সময়ে মানুষের উপর অত্যাচার চালানো হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘চার কোটি নোটিস পাঠালেও লড়াই থেকে আমরা পিছিয়ে আসব না।’ তাঁর দাবি, কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক কর্মী, সংবাদমাধ্যম— সকলকে চাপে রাখা হচ্ছে। ‘যেখানে নিরপেক্ষতা থাকা উচিত, সেখানে পক্ষপাতিত্ব বেড়েই চলেছে।’
বিএলও-দের মৃত্যু প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, গুজরাত ও মধ্যপ্রদেশে যে মৃত্যু হয়েছে, তার দায় কে নেবে? তাঁর বক্তব্য, কৃষিকাজের মরসুমে মাত্র দু’মাসে তিন বছরের কাজ চাপিয়ে দেওয়া অমানবিক। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘বিএলও–দের ৪৮ ঘণ্টা অপেক্ষায় রাখা হয়েছে। এত অহংকার কেন?’
নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দলের প্রতিনিধিদলকে দেখা করতে না দেওয়ার অভিযোগ তোলেন তিনি। তাঁর প্রশ্ন, ‘এখন কি ওরাই ঠিক করবে কারা কার সঙ্গে দেখা করবে?’
বক্তৃতার শেষে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সংবিধানের পথই হবে বাংলার পথ। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দেখানো নির্দেশই বাংলার পথপ্রদর্শক। কোনও রাজনৈতিক দলের নয়। তিনি বিএলও–দের উদ্দেশে জানান, ‘আত্মহত্যা কোনও পথ নয়। জীবন অমূল্য।’
উল্লেখ্য, আজকের বক্তব্যে মুখ্যমন্ত্রী বার্তা দিয়েছেন, বাংলা গণতন্ত্র, মানবিকতা, নাগরিক অধিকার ও ঐক্যের পক্ষেই থাকবে এবং যেকোনও পরিস্থিতিতে সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাবে।