• বন্ধ চেকপোস্টই ‘সফট করিডর’! জঙ্গল থেকে পাচার বন্যপ্রাণ-বনজ সম্পদ, গোয়েন্দা তথ্যে চাঞ্চল্য
    প্রতিদিন | ২৮ নভেম্বর ২০২৫
  • অমিত সিং দেও, মানবাজার: লোকমুখে রয়ে গিয়েছে নাম! কিন্তু বাস্তব বলছে, কয়েক বছর আগেই ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে পুরুলিয়ায় বনদপ্তরের ৫টি চেকপোস্টের। আর এই অবস্থায় ঝাড়খণ্ড ছুঁয়ে থাকা জঙ্গলমহলের পুরুলিয়ায় বিনা বাধায় পাচার হয়ে যাচ্ছে বনজ সম্পদ। শুধু তাই নয় পুরুলিয়ার উপর দিয়েই বন্যপ্রাণ পাচারের ‘সফট করিডর’ হিসাবে ব্যবহার করছে আন্তঃরাজ্য দুষ্কৃতীরা! গোয়েন্দা তথ্যে এই বিষয়টি উঠে এসেছে।

    রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম চক্রের মধ্যে থাকা পুরুলিয়া, কংসাবতী উত্তর ও কংসাবতী দক্ষিণ বনবিভাগের ১৯ টি রেঞ্জ এলাকায় প্রায় এক লক্ষ ২০ হাজার হেক্টর বনভূমি। যার মধ্যে রয়েছে মাঠা, গড় পঞ্চকোটের মত সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এই জেলার জঙ্গলে যেমন দামি দামি দেশজ গাছ রয়েছে, তেমনই বাড়ছে বন্যপ্রাণের সংখ্যাও। অথচ স্রেফ নাকা তল্লাশির অভাবে রাতের অন্ধকারে প্রায় দিনই পাচার হচ্ছে লরি ভর্তি কাঠ। পাচার হয়ে যাচ্ছে নীল গাই থেকে ভারতীয় প্যাঙ্গোলিন। যদিও পুরুলিয়া বনবিভাগের ডিএফও অঞ্জন গুহ জানিয়েছেন, “সম্প্রতি আমরা জঙ্গলকে প্লাস্টিকমুক্ত করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এর জন্য বিভিন্ন জায়গায় নাকা পয়েন্ট করার ভাবনা আছে। আমরা রাজ্যের সঙ্গে কথা বলে দেখছি বন্ধ হয়ে যাওয়া চেকপোস্টগুলি নতুন ভাবে চালু করা যায় কিনা বা অন্য কোথাও নতুন করে শুরু করা যায় কিনা।”

    বনদপ্তরের তথ্য বলছে, পুরুলিয়া-রাঁচি রাজ্য সড়কের উপর পুরুলিয়া বনবিভাগের জয়পুরে ও ঝালদার তুলিনে দুটি স্থায়ী চেকপোস্ট ছিল। ধানবাদ-পুরুলিয়া ৩২ নম্বর জাতীয় সড়ক (বর্তমানে ১৮ নম্বর জাতীয় সড়ক)-র উপরে পুরুলিয়া শহরের উপকন্ঠে কংসাবতী উত্তর বনবিভাগের শিমুলিয়া ও রঘুনাথপুর এলাকায় পৃথক দুটি চেকপোস্ট ছিল। অন্যদিকে, বান্দোয়ান-ঝাড়গ্রাম রাজ্য সড়কের উপর কংসাবতী দক্ষিণ বনবিভাগের যমুনা রেঞ্জের চিরুডিতেও একটি চেকপোস্ট ছিল বলে বনদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে। ওই পোস্টগুলিতে ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করতেন বনকর্মীরা। চেকপোস্টে প্রত্যেক গাড়ির তল্লাশি, বনজ সম্পদ পারাপারের সময় দপ্তরের দেওয়া ট্রানজিট পাস খতিয়ে দেখা হতো, চলত কড়া নজরদারি। তবে ধীরে ধীরে কর্মী সংকটে এক এক করে প্রত্যেকটি চেক পোস্ট বন্ধ হয়ে যায়। আর তারপর থেকেই রাতের অন্ধকারে ছোট ছোট লরিতে শাল, পিয়াল, জাম, মহুলের মতো প্রয়োজনীয় গাছ পাচার রমরমিয়ে চলছে বলে অভিযোগ। পাচার হচ্ছে কেন্দু পাতা, লাক্ষার মতো বনজ সম্পদও। শুধু তাই নয়, ভারতীয় প্যাঙ্গোলিন, নীলগাই, চিতাবাঘের চামড়া থেকে চিতল হরিণের সিংও পাচার করছে দুষ্কৃতীরা।

    পুরুলিয়ার একদিকে যেমন বাংলার বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম বর্ধমানের সীমানা। পাশাপশি ৩৮০ কিমি এলাকা জুড়ে ঝাড়খণ্ডের ৭ টি জেলার সীমানা রয়েছে। সাম্প্রতিককালে বনদপ্তরের কোনও কোনও রেঞ্জ এলাকায় বেআইনি কাঠ পাচারের সময় গাড়ি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। পুলিশ ও বনদপ্তর এবং ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ব্যুরোর হাতে উদ্ধার হয়েছে বিভিন্ন বন্যপ্রাণ ও শরীরের অংশ। গ্রেপ্তারও হয়েছে কয়েকজন। কিন্তু তারপরেও টনক নড়েনি বনদপ্তরের। অবসরপ্রাপ্ত এক আধিকারিকের কথায়, “বিভিন্ন জায়গায় রায়ত জমিতে থাকা গাছ কেটে দপ্তরের বৈধ নথি নিয়ে সেগুলি এই রাজ্যের ভিন জেলা বা ঝাড়খণ্ডে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কে দেখবে সেই সমস্ত নথির আড়ালে ওই গাড়িতেই বেআইনিভাবে জঙ্গলের গাছের গুঁড়ি পাচার হচ্ছে কি না।”

    ওই প্রাক্তন আধিকারিকের কথায়, বিভিন্ন রাস্তায় চেক পোস্ট থাকলে সেখানে বনজ সম্পদ বৈধ নথি যেমন খতিয়ে দেখা যাবে। পাশাপশি অন্যান্য ধরনের অপরাধ অনেকটা রোখা যাবে। কারণ বহু কাঠ ব্যবসায়ীরা বেআইনিভাবে দপ্তরের ট্রানজিট পাস থেকে হাতুড়ি নকল করে। কিন্তু সেগুলি সংশ্লিষ্ট বিভাগের বনকর্মীরা পরীক্ষা না করলে বোঝার উপায় নেই। কয়েক বছর আগেই বাঘমুন্ডি থেকে একটি গাছের গুঁড়ি বোঝাই লরি ঝালদায় আটক করা হয়। তল্লাশি চলানোর সময় বনকর্মীরা দেখেন, ওই গাছের গুঁড়িতে বনদপ্তরের হাতুড়ির চিহ্ন আছে। পরে নকল ওই হাতুড়ি উদ্ধার হয়। এখানেই প্রশ্ন উঠছে, চেকপোস্ট থাকলে যদি প্রাথমিক স্তরেই অপরাধে রাশ টানা সম্ভব। তাহলে কেন সেই সমস্ত বন্ধ হয়ে যাওয়া চেকপোস্ট পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর নেই দপ্তরের আধিকারিকদের কাছে।
  • Link to this news (প্রতিদিন)