১৯ লক্ষ নয়! এনআরসির পরও অসমে ‘বিদেশি’ মাত্র ৩২ হাজার, বিধানসভাতেই ঘোষণা হিমন্ত বিশ্বশর্মা সরকারের
বর্তমান | ২৮ নভেম্বর ২০২৫
বিশেষ সংবাদদাতা, গুয়াহাটি: বিদেশি। অনুপ্রবেশকারী। ঘুসপেটিও। এই শব্দগুলো অসমের মানুষের জন্য যতটা পরিচিত, ততোধিক আতঙ্কের। তার কারণ, এনআরসি। ভারতের একটি মাত্র রাজ্যে এ পর্যন্ত এনআরসি হয়েছে। আর তার সৌজন্যে একটিমাত্র কলমের খোঁচায় মুহূর্তে অ-নাগরিক হয়ে গিয়েছিলেন লাখো লাখো মানুষ। সঠিক সংখ্যাটা ছিল ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জন। তিল ধারণের জায়গা ছিল না ডিটেনশন ক্যাম্পে। আর ছিল অপেক্ষার প্রহর গোনা—কবে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে রাষ্ট্র তাদের সীমান্তের ওপারে ফেলে দেবে। কিন্তু ছ’বছরের দীর্ঘ টানাপোড়েন, কলম পেষাই, আর ১ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা খরচের পর ঠিক কতজনকে ‘বিদেশি’ তকমা দেওয়া হয়েছে? ২০২১ থেকে এপর্যন্ত ৩২ হাজার ২০৭ জন। এবং পুশব্যাক? মাত্র ১ হাজার ৪১৬ জন। এই তথ্য হাওয়ায় ভাসছে না। কংগ্রেস বিধায়ক আবদুর রহিম আহমেদের এক প্রশ্নের লিখিত জবাবে অসম চুক্তি বাস্তবায়নমন্ত্রী অতুল বোরা নিজেই এই পরিসংখ্যান দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ২০২১ সালে হিমন্ত বিশ্বশর্মা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে চলতি বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত অসমে অবৈধভাবে বসবাস করা মোট ৩২ হাজার ২০৭ জন বিদেশি হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২০২১ সালে ৬ হাজার ৩০৪ জন, ২০২২ সালে ৮ হাজার ৭৯০ জন, ২০২৩ সালে ৬ হাজার ৭০৩ জন, ২০২৪ সালে ৬ হাজার ১২০ জন এবং ২০২৫ সালে ৪ হাজার ২৯০ জন বিদেশিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৪১৬ জনকে অসম থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, তাহলে যে ১৯ লক্ষ নাম বাদ যাওয়ার ঘোষণা করা হয়েছিল, তাঁরা সবাই কি ‘বিদেশি’ বা ‘অনুপ্রবেশকারী’ নন? তাহলে তাঁদের নাম এনআরসিতে ওঠেনি কেন? নজর করার মতো বিষয় হল, এনআরসি চালুর পর থেকে ২০২১ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সর্বানন্দ সোনেওয়াল। তখন কিন্তু হিমন্ত কার্যত এনআরসির বিরোধিতাই করেছিলেন। অথচ, কুর্সিতে বসার পরও ভোল বদলে গেল! বিরোধীরা বলছে, ১৯ লক্ষ থেকে ৩২ হাজারে পরিসংখ্যান নেমে আসার অর্থ, নিশ্চিতভাবে প্রক্রিয়ায় গলদ ছিল! তারপরও গত কয়েক বছর ধরে ‘বিদেশি’দের ফেরত পাঠানো নিয়ে হিমন্ত বিশ্বশর্মাই গালভরা মন্তব্য করে গিয়েছেন। প্রশ্ন উঠছে, আম জনতার করের কোটি কোটি টাকার যে ‘শ্রাদ্ধ’ হয়েছে, তার হিসেব কে দেবে? সবচেয়ে বড় কথা, বছরের পর বছর অনিশ্চয়তা, আতঙ্কের আবহে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ দিন গুজরান করেছেন, তা কি ফিরিয়ে দেওয়া যাবে? সূত্রের খবর, হিমন্ত বিশ্বশর্মা যে হাজার কোটি টাকা খরচের দাবি করেছেন, আসল অঙ্কটা এর থেকে অনেক বেশি। তার মধ্যে রয়েছে শুধু ৪৬ কোটি টাকারই ডিটেনশন ক্যাম্প। অথচ, সেই সব ‘কেন্দ্রে’র অধিকাংশই স্রেফ অব্যবহৃত। তাছাড়া অসমজুড়ে যে হাজার খানেক ফরেনার্স ট্রাইবিউনাল খোলা হয়েছিল, তাতেও খরচ হয়েছে মোটা টাকা। ২০২২ সালে ক্যাগ জানিয়েছিল, এনআরসি প্রক্রিয়ায় বিপুল আর্থিক অসংগতি রয়েছে। হিমন্ত সরকারের পরিসংখ্যান কিন্তু সেই আগুনেই ঘি দিল। আর বিধানসভায় দলের মন্ত্রীর দেওয়া এই তথ্যের সপক্ষে বলতে গিয়ে বিতর্ক আরও একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছেন বিজেপিরই সাংসদ দিলীপ সইকিয়া। দারাং-উদালগুড়ি এমপি বলেন, ‘সরকার যা তথ্য দিয়েছে, সেটা প্রামাণ্য। বিদেশিদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া প্রায় প্রতিদিনই হচ্ছে।’ কিন্তু সেই সংখ্যা কত, তা নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে পারেননি তিনি। কংগ্রেস অবশ্য এই সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। দলের মুখপাত্র মহসিন খান বলেন, ‘বিদেশিদের ফেরত পাঠানোর যে সংখ্যা বিধানসভায় বলা হয়েছে, সেটা সন্দেহজনক। কারণ ১ হাজার ৪১৬ জনকে পুশব্যাক করা হলে সেটা অবশ্যই প্রচারের আলোতে আসত। সম্প্রতি ধুবড়ির মনকাছাড় সীমান্ত দিয়ে খাইরুল ইসলাম নামক এক ব্যক্তিকে পুশব্যাক করার পর তাঁকে আবার অসমে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এই ঘটনা যদি সামনে আসে, তাহলে ১ হাজার ৪১৬ জনকে সরকার সফলভাবে ফেরত পাঠাল, অথচ কেউ জানতে পারল না?’
এখানেই শেষ নয়। বিধানসভায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রী বোরা বলেন, ধুবরি, দক্ষিণ সালমারা-মানকাচার, কাছাড় এবং শ্রীভূমি জেলা জুড়ে বিস্তৃত বাংলাদেশের সাথে মোট ২৬৭.৫ কিমির আন্তর্জাতিক সীমান্তের মধ্যে ২২৮.৫৪১ কিমির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) আপত্তির কারণে শ্রীভূমিতে কুশিয়ারা নদীর তীরে ৪.৩৫ কিমি সীমান্তে বেড়া দেওয়ার কাজ বাকি। তাহলে কি অনুপ্রবেশ এখনও ঘটে চলেছে? তার দায় কে নেবে? অসমে কিন্তু বিরোধী নয়, সরকার ডাবল ইঞ্জিন।