বন্ধুদের ঠাট্টা-ইয়ার্কি নেই, ছাদনাতলা দখল বাউন্সারদের!
বর্তমান | ২৮ নভেম্বর ২০২৫
অনিমেষ মণ্ডল, কাটোয়া: ‘শুন সবে এবে আমি করি নিবেদন। ছাদনাতলায় এসেছে বর বৃষভবাহন।’—পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যেই এমন শ্লোকের ফুট কেটে চুপ করে যেতেন নরসুন্দর। নাপিতের মুখে আর কোনও কথা নেই। বিয়ের আনন্দধারায় শুধু সলতে পাকিয়ে দিয়ে তিনি মুচকি হাসতেন। গুরুগম্ভীর পরিবেশে এই ‘কমিক রিলিফ’ পেয়েই ঠাট্টা-তামাশা, ইয়ার্কি-মশকরাতে মশগুল হতেন বরের বন্ধুরা। হইহুল্লোড়ে মেতে উঠতেন কনেপক্ষের লোকজনও। বাঙালির বিবাহ বাসরের সেই দিন, সেই ঐতিহ্য কি জেন-জি’র পাল্লায় পড়ে আজ অস্তমিত?
প্রশ্নটা উস্কে দিল কাটোয়া শহরের একটি বিয়েবাড়ি! যেখানে বরের বন্ধুদের ঠাট্টা-মশকরা নেই। শ্লোকের ফুট কাটা নেই। নরসুন্দরের মুখে কোনও হাসি নেই। রয়েছে শুধু কড়া কড়া পাঁচ জোড়া চোখের সতর্ক চাহনি। ছাদনাতলা নিয়ন্ত্রণের ভার তাঁদের কাঁধেই। সবার হাতে ওয়াকিটকি। ভারী বুটের আওয়াজ তুলে পাক খাওয়া। নবদম্পতিকে আগলে রাখা। এঁরা নাকি সকলেই বাউন্সার! বন্ধুদের বদলে ছাদনাতলা দখল তাঁদেরই। এমন বিয়েবাড়ি থেকে তাজ্জব শহরবাসীর একটা বড় অংশ। বিশেষ করে প্রবীণ মানুষজন বাঙালির কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে এহেন স্বাদবদল ঠিক নিতে পারছেন না। আক্ষেপ করে তাঁরা বলছেন, ‘কী দিনকাল পড়ল রে বাপু! শেষে কি না ছাদনাতলায় ভাড়াটে বাউন্সার!’
কাটোয়া শহরের পানুহাট ইঁদারাপাড়ের বাসিন্দা অপূর্ব দেবনাথ। বুধবার রাতে বিয়ে সেরেছেন একটি লজে। বরযাত্রী নিয়ে যাওয়া থেকে ছাদনাতলা পর্যন্ত পাঁচজন বাউন্সারবেষ্টিত ছিলেন তিনি। অপূর্ব বলছিলেন, ‘আসলে ঘোড়ায় টানা গাড়ি দেখে অনেকেই সেল্ফি তুলতে ভিড় জমাচ্ছেন। তাই বাউন্সার ভাড়া করেছিলাম।’
গত পাঁচ-সাত বছরে বাঙালির বিয়েবাড়ির আচার-আচরণ বদলেছে অনেকটাই। বিয়ের আগে প্রি-ওয়েডিং শ্যুট, মেহেন্দি অনুষ্ঠান, ব্যান্ড বাজিয়ে ঘট ভরতে যাওয়া, নামজাদা কোনও পর্যটনকেন্দ্রে বিয়ের কুঞ্জ সাজানো। কিন্তু এসবের মধ্যেও বাঙালিদের বিয়ের নান্দনিকতা ও রসবোধ খানিক বজায় ছিল। যেমন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবীদের হইচই। সবার মধ্যে একটা আন্তরিক আত্মীয়তার হাবভাব। খোঁপায় বেলিফুলের মালা বেঁধে মহিলাদের উচ্ছ্বাস-উন্মাদনা। বর ও কনেপক্ষের মধ্যে মিষ্টি ছোড়াছুঁড়ি। এই সব সোনালি রীতি-রেওয়াজ ভুলে কি না বাউন্সারদের ঘেরাটোপে বিয়ে! এমন নজির বোধহয় বাংলায় এখনও নেই। পথ দেখাল কাটোয়া! মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে শহরের বয়ষ্ক লোকেদের। রাগতভাবে তাঁরা বলছেন, ‘বর্তমান প্রজন্মের হাতেই বোধহয় বাঙালির বিয়ের ঐতিহ্যের শেষের শুরু।’
কাটোয়া শহরের বিশিষ্ট শিক্ষক গবেষক তুষার পণ্ডিত বলছিলেন, ‘উচ্চমধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যে ইদানীং অবাঙালী সংস্কৃতি অনুকরণের প্রবণতা শুরু হয়েছে। এখন বিয়ে বলতেই সবার প্রথমেই ব্যাঙ্কোয়েট ভাড়া, কয়েক হাজার টাকা খরচ করে কলকাতা থেকে ঘোড়ায় টানা গাড়ি আনা। মেহেন্দির অনুষ্ঠান করা। ফিল্মি কায়দায় নদী, পাহাড়, ঝরনা, রাজবাড়িতে প্রি-ওয়েডিং শ্যুট। এসব বাঙালির বিয়ের ঐতিহ্যে ঠিক খাপ খায় না।’ কাটোয়া শহরের চিত্রগ্রাহক দেবরাজ ঘোষের কথায়, ‘এখন নতুন প্রজন্মের মধ্যেই কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে প্রি ওয়েডিং শ্যুট করার প্রবণতা বাড়ছে। দক্ষিণী সিনেমার অনুকরণে ছবির কালার করা হচ্ছে। তাই জমিদার বাড়ি থেকে, পাহাড়, জঙ্গল সব জায়গাতেই আউটডোর শ্যুটের জন্য আমাদের যেতে হচ্ছে।’
বাঙালির বিয়েতে এতসব বদলের মধ্যেও আন্তরিকতা, ছাদনাতলার ইয়ার্কি-ফাজলামো ঐতিহ্য বজায় ছিল। এবার সেই ঐতিহ্যে সম্ভবত ফাটল ধরাল বাউন্সারদের ওয়াকিটকি! নবদম্পতিকে ঘিরে বাউন্সাররা। নিজস্ব চিত্র