‘মান্না ৪০, ভূপেন হাজারিকা ৩৫, সন্ধ্যা-শ্যামল ২৫ টাকা’! লং প্লেয়িং রেকর্ডে গান শোনানোর স্কুল রাস্তাতেই
বর্তমান | ০১ ডিসেম্বর ২০২৫
সুকান্ত বসু, কলকাতা: যে গানগুলো লং প্লেয়িং রেকর্ডে বাজত, যে গানগুলো যুগে পর যুগ মাতাল করে রাখত-রাখে পুজোর প্যান্ডেল, ড্রয়িং রুম, সে গানগুলোর লং প্লেয়িং রেকর্ড জমায় রফিক মোল্লা। শুধু কি জমায়? সংগ্রহ করে, বিক্রিও করে। শীত হোক কি গ্রীষ্ম, বসন্ত হোক বা শরৎ, রফিক পাড়ায় ঢুকলে মনেই হয় না যে, পুজো চলে গিয়েছে। সে ঢুকলে আচমকা আনন্দ। কলকাতার রাজপথ দিয়েই হাঁটে এই গান শোনানোর স্কুল।
ফলে সে আসা মানেই বুকের ভিতর উৎসব। উত্তর-উত্তর শহরতলি থেকে মধ্য কলকাতা। সাইকেলে চক্কর কাটে রফিক মোল্লা। হ্যান্ডেলে বাঁধা একটি লং প্লেয়িং রেকর্ড। আর ব্যাগে আরও কমকরে শ’খানেক। ব্যাগভর্তি হেমন্ত-মান্না-সন্ধ্যা-শ্যামল-ধনঞ্জয়-সতীনাথ-লতা-আশা-মানবেন্দ্র-ধনঞ্জয়-রামকুমার-প্রতিমা-যূথিকা-আরতি-ভূপেন হাজারিকার গান। যুগ যুগ ধরে সে বাংলা গান মণ্ডপে বাজে। এবছরও বেজেছে। পুজোর আমেজ রয়ে গিয়েছে আরও কিছুদিন।
রফিক যে কাজটি করেন তা অভিনব। চমকপ্রদ। এবং কিছুটা বিস্ময়করও বটে। এ যুগে সিডি-ডিভিডি গিয়েছে বাতিল হয়ে। ক্যাসেট তো তামাদিই। মোবাইল খুললেই এখন গান। স্মৃতিতে থাকা অধিকাংশ গান মোবাইল অ্যাপে বন্দি। চাইলেই শোনার সুযোগ। এই হাইটেক যুগে রফিক বিক্রি করেন গানের রেকর্ড! অনেকেরই বক্তব্য, ‘কলকাতায় গোরুখোঁজা খোঁজার পর তবে হাতে গোনা কয়েকটি দোকানের সন্ধান পাওয়া যায়। যে রেকর্ডের একদা দুনিয়াজোড়া ব্যাপ্তি ছিল তা এখন গোষ্পদে বাধা পড়ে গিয়েছে। খুব শৌখিন কিছু মানুষের সংগ্রহেই থাকে শুধু রেকর্ড। খুবই কম বাড়িতে বাজানো হয়। সে যুগে দাঁড়িয়ে রেকর্ড বিক্রি করছেন রফিক! বিস্ময় তো জাগেই।’
রফিক যদিও প্রশ্ন শুনে বলেন, ‘রেকর্ড কেনার বহু লোক এখনও কলকাতায় আছেন। অনেকেই দুষ্প্রাপ্য কিছু রেকর্ড বিক্রি করে দেন আমাকে।’ দূরের এক জানলা দিয়ে মুখ বের করে একজন ডাকলেন তাঁকে। শ্যামপুকুর স্ট্রিট ধরে একটু এগলেন রফিক। চিৎকার শুরু করলেন আবার‑‘মান্না দে ৪০ টাকা, ভূপেন হাজারিকা ৩৫, কিশোর ৩৫, রফি ৩৫ টাকা, সন্ধ্যা-শ্যামল ২৫ টাকা।’ তবে এ দামের বাইরেও বাড়তি মূল্য আছে কিছু রেকর্ডের। মেহেদি হাসানের একটি দুষ্প্রাপ্য গান তাঁর হাতে এসেছিল। বিক্রি হয়েছিল দু’হাজার টাকায়। আঙুরবালার রেকর্ড একজন কিনেছিলেন দেড় হাজার দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে বউবাজার জেলেপাড়া। গলিতে দাঁড়িয়ে রফিক শোনান, ‘পুজোর আগে বাঙালিবাবুদের বাড়ি আবর্জনা পরিষ্কার হয়। তখন অনেকে পুরনো জিনিসপত্র বিক্রি করে দেন। কখনও একসঙ্গে পাঁচ-দশটা পেয়ে যাই।’
সন্ধ্যা হয় হয়। রাস্তার লাইট জ্বলে উঠেছে। গানওয়ালা রওনা দেন। দূর থেকে তাঁকে দেখে ছেলেবেলার সেই বেহালা বাজানো লোকটার কথাই বারবার মনে হয়, যে গান শুনিয়ে চলে যায় বটে তবে রেখে যায় উৎসবের রেশ।