ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) নিয়ে মতুয়াদের একাংশের উদ্বেগ ছিলই। ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা ‘অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘ’-এ সঙ্ঘাধিপতি শান্তনু ঠাকুরের সাম্প্রতিক মন্তব্যে তাঁদের নতুন করে উদ্বেগ বাড়ল। পরিস্থিতি নিয়ে সরব সিপিএম, কংগ্রেসও।
বনগাঁর বিজেপি সাংসদ শান্তনু শুক্রবার দাবি করেন, ‘‘বলেছিলাম, এক কোটির মতো মানুষের নাম বাদ যাবে। সেই আশঙ্কা থেকেই দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশি মুসলিম, রোহিঙ্গারা পালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, এসআইআরে নাম বাদ গেলে ধরপাকড় হবে। ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠাবে।’’ এতেই প্রমাদ গুনছেন মতুয়াদের একটা বড় অংশ। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে (সিএএ) আবেদন করার জন্য শিবির চলছে শান্তনুর নেতৃত্বে। মতুয়াদের একাংশের ধারণা, কেউ যদি সিএএ-তে আবেদন করেন, তা হলে সরকারের কাছে নথিভুক্ত থাকবে, আবেদনকারী বাংলাদেশি। সে নথি দেখিয়েই ভবিষ্যতে তাঁকে তাড়ানোর অধিকার থাকবে সরকারের। তা ছাড়া, সেখানে আবেদনকারী কত জনের নাম শেষ পর্যন্ত ভোটার-তালিকায় ঠাঁই পাবে, সংশয় থাকছে। ফলে, ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’-এ যেতে হবে কি না, তা ভেবেই উদ্বিগ্ন তাঁরা।
দীর্ঘদিন ধরেই মতুয়াদের একাংশ তৃণমূল সাংসদ মমতা ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘের সদস্য হিসেবে (সিএএ) বাতিল করে নিঃশর্ত নাগরিকত্বের দাবিতে আন্দোলন করছেন। সম্প্রতি অনশন কর্মসূচিও করেন। মতুয়াদের অন্য অংশ শান্তনু ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন আর এক ‘অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘ’-এর সদস্য। তাঁদের একাংশ সিএএ-তে আবেদন করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে। এখন তাঁরাও দুশ্চিন্তায়।
তেমনই এক জন সঞ্জয় বিশ্বাস সিএএ-তে আবেদন করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যখন ডিটেনশন ক্যাম্পের কথা বলছেন, তখন ভয় তো লাগবেই। ফলে, ভোটার-তালিকায় নাম না থাকলে কী হবে, ভাবতে পারছি না।’’ ধীরেন বিশ্বাস নামে এক মতুয়া ভক্তও কয়েক মাস আগে সিএএ-তে আবেদন করেন। তিনিও বলেন, ‘‘এসআইআরে শুনছি, ভোটার-তালিকা থেকে নাম বাদ যেতে পারে। আতঙ্কে আছি।’’
গৌরাঙ্গ মণ্ডল নামে আর এক মতুয়া ভক্ত এখনও সিএএ-তে আবেদন করেননি। তিনি বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভরসাতেই আছি। তিনি বলেছেন, তিনি থাকতে কেউ আমাদের তাড়াতে পারবে না।’’ উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরে মতুয়া ঠাকুরবাড়িতে নিয়মিত আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মতুয়া-ভক্ত সিএএ-র মাধ্যমে নাগরিকত্ব পেয়েছেন বলে দাবি করেও বলেন, ‘‘ওটা এসআইআর-প্রক্রিয়ায় গ্রহণ হবে কি না, জানি না।’’
সিএএ-তে নদিয়া জেলায় প্রথম নাগরিকত্ব শংসাপত্র পান আসাননগরের বাসিন্দা, বছর পঁয়ত্রিশের বিকাশ মণ্ডল। পরে, তিনি বাবা-মা এবং স্ত্রীর জন্যেও আবেদন করেছেন। বিকাশ বলেন, “ভয়ের কী আছে! এখন আমি বৈধ নাগরিক। বাবা-মা ও স্ত্রীও নাগরিকত্বের শংসাপত্র পেয়ে যাবেন। সব নথিই জমা দিয়েছি।” তাঁরা অবশ্য মতুয়া নন।
শান্তনুর দাবি, এসআইআরে মতুয়া উদ্বাস্তুদের নাম বেশি বাদ যাবে না। কারণ, ৬০-৭০ শতাংশ মতুয়া উদ্বাস্তু মানুষ জন্মসূত্রেই ভারতীয়। ২০০২ সালের পরে যাঁরা এসেছেন, তেমন কিছু নাম ভোটার-তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে। তাতেও উদ্বেগের কিছু নেই। তিনি বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে যে সব মতুয়া উদ্বাস্তু মানুষ ও পার বাংলা থেকে এসেছেন, তাঁদের এ দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে না। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা নাগরিক হবেন। ভোটার-তালিকায় নামও উঠবে।’’ তৃণমূল সাংসদ মমতা ঠাকুর পাল্টা বলেন, ‘‘আমাদের অনশনকারীদের শান্তনু বলেছিল, ‘রোহিঙ্গা এবং মুসলিম’। মতুয়া উদ্বাস্তুদের ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানোর ষড়যন্ত্র করেছে।’’
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, “শান্তনু ঠাকুরের কাছে প্রশ্ন, যাঁদের ভোটে ২০২৪-এ সাংসদ-মন্ত্রী হয়েছেন, তাঁরা সবাই ২০২৬-এ ভোট দিতে পারবেন, এই নিশ্চয়তা দিতে পারবেন? আপনার কথার অর্থ, মতুয়া-সহ যাঁদের নাম এসআইআর-এ বাদ যাবে, তাঁদের সবাইকে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’-এ যেতে হবে।’’ প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র সুমন রায়চৌধুরী বলেন, “যিনি সিএএ-ফর্মে সই করে ভারতের নাগরিক হতে চান, আবার মন্ত্রী হয়ে সব সুবিধা ভোগ করেন, সেই শান্তনু ঠাকুরের মুখে এমন কথা দ্বিচারিতা।”