শীত পড়তেই দেশি-বিদেশি পর্যটকের দল আসে কালনা শহরে। সকালে ভাগীরথীর ঘাটে সাজানো লঞ্চে উঠে তাঁরা ঘুরে দেখেন কালনার নানা প্রাচীন নিদর্শন— ১০৮ শিবমন্দির, প্রতাপেশ্বর, লালজি মন্দির। কিন্তু শহরে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়েই ফিরে যান তাঁরা। না কোনও কেনাকাটা, না এলাকায় রাত্রিযাপন। ফলে বছরের পর বছর পর্যটকদের আনাগোনা সত্ত্বেও স্থানীয় অর্থনীতিতে এর কোনও প্রভাব পড়ে না। শহরবাসীর ক্ষোভ, পর্যটন ঘিরে প্রশাসনের কোনও স্পষ্ট পরিকল্পনা নেই, কোনও পর্যটন-পরিকাঠামো তৈরি হয়নি। সেই কারণেই বিদেশি পর্যটকেরা বেশি সময় কাটান না। প্রশাসনের উদাসীনতায় বেশ কিছু প্রাচীন নিদর্শন নষ্ট হতে বসেছে বলেও অভিযোগ।
আমেরিকা, নেদারল্যান্ড, কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া-সহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিবারই পর্যটকেরা আসেন কালনায়। সঙ্গে থাকেন গাইড। তাঁরা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি দেখিয়ে তার গুরুত্ব ও ইতিহাস বর্ণনা করেন। শেষে বিদেশি পর্যটকেরা আশপাশের ফল, মাছ ও আনাজের বাজার ঘোরেন এবং লঞ্চে ফিরে যান। সাধারণত কোথাও ঘুরতে গেলে সেখানকার কোনও জিনিস, খাবার নিয়ে যাওয়ার যে রীতি থাকে, তা এ ক্ষেত্রে দেখা যায় না। নিজেদের ক্যামেরা বা মোবাইলে তোলা ছবি বাদে কোনও স্মৃতিচিহ্নই নিয়ে যান না বিদেশিরা। বাসিন্দাদের দাবি, কালনা ও আশপাশের তাঁত, মিষ্টি অনেক কিছুই বিখ্যাত। কিন্তু পর্যটন স্থলের আশপাশে তেমন কিছুই বিক্রির ব্যবস্থা নেই। শহরের বাসিন্দা মৃন্ময় মণ্ডলের মতে, ধাত্রীগ্রাম-সমুদ্রগড়ের তাঁতশিল্প, শীতের নলেন গুড়ের সন্দেশ, মন্দিরের টেরাকোটার কারুকার্য কেন্দ্র করে মাটির নানা সামগ্রী সবই বিভিন্ন স্টলের মাধ্যমে পর্যটকদের কাছে উপস্থাপনের মতো। স্থানীয় ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গাইড তৈরি করাও সম্ভব। কিন্তু প্রয়োজন পরিকল্পনার। তিনি বলেন, “যখন পর্যটকেরা শহর থেকে খাবার-সব নানা সামগ্রী কিনবেন, তখনই এলাকার অর্থনীতির উন্নতি হবে।”
শহরের আর এক বাসিন্দা পিঙ্কি চট্টোপাধ্যায়ের পরামর্শ, ভাগীরথীর ধারে বা প্রাচীন নিদর্শনের পাশে প্রয়োজন কটেজ বা হোটেল। লঞ্চভ্রমণ-সহ পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থাও জরুরি। তা হলে পর্যটকেরা রাত কাটানোর কথা ভাববেন। তিনি বলেন, “বহু বছর ধরে শুনে আসছি সরকারের উদ্যোগে পর্যটক আবাস, কিছু রাস্তাকে পর্যটন উপযোগী করে তোলা হবে। পুরাকীর্তির আশপাশে হোমস্টে তৈরির পরিকল্পনাও শুনেছি। কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি।”
প্রসঙ্গত পুরসভার আগের বোর্ড ভাগীরথীর তিনটি চরকে কেন্দ্র করে একটি ইকো টুরিজ়ম প্রকল্প নেয়। জৈববৈচিত্র পর্ষদের সদস্যেরা বার বার লঞ্চে এলাকা ঘুরে দেখেন, মাপজোক, গভীরতা মাপা, মাটি পরীক্ষা সবই হয়। কিন্তু কয়েক কোটি টাকার সেই প্রকল্প আজও বাস্তবায়িত হয়নি। কেন? উত্তরে কালনার উপপুরপ্রধান তপন পোড়েল বলেন, “পোর্টট্রাস্টের অনুমতি পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হয়েছে বলে শুনেছি। খোঁজ নিয়ে দেখব।”
এরই মধ্যে শহরবাসীর ক্ষোভ বাড়ছে। তাঁদের দাবি, প্রশাসনিক উদাসীনতায় সমাজবাড়ির জমি বিক্রি হয়েছে, জগন্নাথতলার জোড়া শিবমন্দির এবং দাঁতনকাঠিতলার হাবসি আমলের মসজিদ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আরও কয়েকটি পুরাকীর্তি নষ্ট হতে বসেছে। শাসকদলের এক পুর প্রতিনিধির দাবি, “গত সাড়ে তিন বছর নানা অস্থিরতায় কেটেছে। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে অসংখ্য রাস্তা বেহাল। সেগুলিই এখনও মেরামত করতে পারিনি। পর্যটন পরিকল্পনা আরও দূরের কথা।” সদ্য দায়িত্ব নেওয়া কালনার মহকুমাশাসক অহিনসা জৈন বলেন, “পর্যটকদের জন্য কী করা যায়, তা নিয়ে পরিকল্পনা করা হবে।”