কৌশিক দে, মালদা
মাত্র ১৫ বছর বয়সে কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন জাহিদ শেখ। তার পরে হঠাৎই খবর আসে, তিনি মেলায় হারিয়ে গিয়েছেন। পরে দুর্ঘটনায় জখম হওয়ার খবর আসে। তার পর থেকে আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি তাঁর। বাড়ির লোক ধরেই নেন যে, তিনি মারা গিয়েছেন।
ধর্মীয় রীতি মেনে সমস্ত কাজ শেষ করে পরিবার। কিন্তু সেলুলয়েডের মতো নাটকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটল ৫৩ বছরের জাহিদের। রবিবার সকালে সস্ত্রীক পৈতৃক ভিটেয় হাজির বাড়ির ছোট ছেলে জাহিদ। তিনি আর চেনা নাবালকটি নন, রীতিমতো পাকা চুল-দাড়ি সমেত প্রৌঢ়। জাহিদকে প্রথমে দেখে যেন ভিরমি খান পরিবারের লোকেরা। তার পরে দেওয়ালে টাঙানো 'মৃত' ভাইয়ের ফটো থেকে নামানো হয় মালা!
মালদার কালিয়াচক থানার নওদা-যদুপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের নয়াগ্রামের ঘটনা। বাবা-মা আগেই মারা গিয়েছেন। এখন পৈত্রিক বাড়িতে থাকেন দাদা-বৌদি-বোনেরা। এ দিন সকালে হঠাৎই জাহিদ তাঁর স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে সেই বাড়িতে হাজির হতেই চক্ষু চড়কগাছ দাদাদের। জাহিদ নিজেকে তাঁদের ভাই বলে দাবি করেন।
প্রমাণস্বরূপ ছোটবেলার নানা গল্প গড়গড় করে বলে যেতে থাকেন। তাতেই দাদারা নিশ্চিত হন, এই মানুষটাই তাঁদের ভাই। কিন্তু এতদিন কোথায় ছিলেন তিনি? জাহিদের দাবি, ১৫ বছর বয়সে গ্রামের আরও বেশ কয়েকজনের সঙ্গে তিনি পাঞ্জাবে গিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে। সেখানে দিনমজুরি করতেন।
একদিন মেলা দেখতে গিয়ে হারিয়ে যান। তখনই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হাত, পা, মাথায় গুরুতর চোট লাগে। তাঁর কথায়, 'তার পর থেকে আর কিছুই মনে ছিল না। ধীরে ধীরে সুস্থ হওয়ার পরে এক ভিক্ষুকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেখান থেকে স্থানীয়দের সাহায্যে উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদে চলে আসি। একটা ফার্মে কাজ পাই।'
গাজিয়াবাদের এক মেয়েকে বিয়েও করেন। তখনও মালদার স্মৃতি বলে কিছু নেই। জাহিদ বলেন, 'বছর দুই-তিনেক আগে হঠাৎই বাবা-মা, দাদা-বোনদের কথা মনে পড়তে শুরু করে। মনে পড়ে কালিয়াচক, নওদা-যদুপুর। কিন্তু ৩৮ বছর পরে মালদায় বাবার বাড়িতে ফেরার সাহস পাচ্ছিলাম না।
ছেলেমেয়ের আবদার ছিল, ওদের দাদুর বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে। সেই আবদার রাখতেই খুঁজতে খুঁজতে চলে আসি।' তাঁর স্ত্রী সাকিনার কথায়, 'স্বামীর মুখ থেকে দু'বছর ধরে মালদার শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কে অল্পবিস্তর শুনেছি। ওর কথাগুলো আমি কাগজে লিখে রাখতাম।
মালদায় এসে শ্বশুর-শাশুড়িকে না-পেলেও ভাসুর, ননদদের পেলাম।' জাহিদের দুই দাদা মহম্মদ সুলতান সেখ ও ওমর শেখ বলেন, 'ভাই হারিয়ে যাওয়ায় থানায় নিখোঁজের অভিযোগ করা হয়েছিল। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম ও আর বেঁচে নেই। কিন্তু ও যে এ ভাবে ফিরে আসবে স্বপ্নেও ভাবিনি।'
জাহিদের ফেরার খবর চাউর হতেই গোটা গ্রামে হইচই পড়ে যায়। অনেকেই সুলতানদের বাড়িতে চলে আসেন তাঁকে দেখতে। অনেক গ্রামবাসী অবশ্য ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা 'সার'-এ নাম বাদ যেতে পারে, তাই এতদিন পরে জাহিদ এসেছে বলে কটাক্ষ করেছেন। তবে প্রকাশ্যে কেউ এ নিয়ে কিছু বলতে চাননি। যদিও এ তত্ত্ব খারিজ করে দিয়েছেন দাদারা।