• ১৫ বছরের ‘উন্নয়নের পাঁচালি’ পেশ মুখ্যমন্ত্রীর
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫
  • মঙ্গলবার ছাব্বিশের ভোটের দাদামা বাজিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। তার আগে ১৫ বছরের উন্নয়নের খতিয়ান পেশ করলেন মুখ্যমন্ত্রী। ২০১১ সাল থেকে টানা ১৫ বছরের নানা সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন দপ্তরের কাজ এবং  তাতে রাজ্যবাসী কতটা উপকৃত হয়েছেন, সেই তথ্য-পরিসংখ্যান নবান্নে তুলে ধরলেন মমতা। ‘উন্নয়নের পাঁচালি’ নামে রিপোর্ট পেশ করেন তিনি। সরকার ও শাসকদলের অনেকে একে মমতার ‘পথের পাঁচালি’ বলেও অভিহিত করছেন। মমতা বলেন, ‘আমাদের মা-ঠাকুমারা পাঁচালি পড়তেন। এখনও গ্রামের কিছু কিছু জায়গায় সেই চল রয়েছে। সেই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতেই আমরা পাঁচালি শব্দটা ব্যবহার করলাম।’

    গত ১৫ বছরে রাজ্যের জিডিপি বেড়েছে ৪.৪১ গুণ আর কর আদায় হয়েছে ৫ গুণ। এছাড়া রাজ্যজুড়ে অসংখ্য ছোট ছোট কর্মসংস্থান ও স্বনির্ভর প্রকল্প হয়েছে বলে এদিন নবান্নে জানানো হয়েছে। যা পরিসংখ্যানের নিরিখে অত্যন্ত ভালো বলেই মনে করা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য , ‘বাংলা এখন সারা দেশের মডেল।‘ ২০১১ সালের নিরিখে রাজ্যের কর আদায় পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে নবান্ন থেকে জানান মুখ্যমন্ত্রী। ২০২১ সালে নির্বাচনের আগে লক্ষ্মী ভাণ্ডার ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই বারের ভোটে জাদুকাঠির মতো কাজ করেছিল লক্ষ্মী ভাণ্ডার। ছাব্বিশের ভোটের আগে পেশ করা হল ‘উন্নয়ন পাঁচালি’।

    Advertisement

    রিপোর্ট পেশ করার আগে এদিন একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়। তথ্যচিত্রে অজস্র সামাজিক প্রকল্প, পরিকাঠামো উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য দিক, খরচের হিসাব তুলে ধরা হয়। এরপরেই মঞ্চে ডাকা হয় সঙ্গীত শিল্পী ইমন চক্রবর্তীকে। ইমন কীর্তনের আঙ্গিকে খোল-খঞ্জনির সঙ্গে ‘পাঁচালি’ পাঠ করেন। তাতে সরকারি প্রকল্প, সরকারের অভিমুখ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা দেওয়া হয়।

    ২০২১ সালে ভোটের মুখে লক্ষ্মী ভাণ্ডারকে বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল তৃণমূল সরকার। যত দিন বেড়েছে এই প্রকল্পে উপভোক্তার সংখ্যা বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ সংখ্যালঘু মহিলাও ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’-এর সুবিধাভোগী। ছাব্বিশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতা নতুন দাওয়াই। ‘উন্নয়নের পাঁচালি’কে পেশ করলেন। ধর্মের বেড়া ভেঙে ‘পাঁচালি’কে বাঙালির করে তুলতে চাইছেন তিনি। ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’, ‘উন্নয়নের পাঁচালি’র মতো শব্দ ব্যবহারকে রাজনৈতিক কৌশল বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। যাতে রয়েছে হিন্দুধর্মের ছোঁয়া। বিজেপি হিন্দুত্বে শান দিতে যা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।

    ‘উন্নয়নের পাঁচালি’ পেশ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আগামী বছর মে মাস এলে আমাদের সরকারের ১৫ বছর পূর্ণ হবে। এই সাড়ে ১৪ বছরে আমাদের সরকার কী কী কাজ করেছে, তা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরছি। আমরা রাজ্যবাসীর কাছে দায়বদ্ধ।’ সম্পূর্ণ তথ্য একত্রিত করা যায়নি বলেও এদিন তিনি জানান। কাজ সম্পূর্ণ করতে আরও সাত-দশ দিন লাগবে বলেও এদিন জানানো হয়। মঙ্গলবার মমতা সার্বিক ভাবে কোন প্রকল্পে কত খরচ বেড়েছে, কত সুবিধাভোগী, তার কিছু পরিসংখ্যান দেন।

    সাধারণ মানুষের কাজ গুরুত্ব দিয়ে করার বার্তা দেন মুখ্যমন্ত্রী। আবাস, সড়ক, জলসংযোগ, স্বাস্থ্য বিষয়ক পরিকাঠামো-সহ অন্যান্য কাজের গতি যাতে ঠিক থাকে তার জন্য ১০ জন আধিকারিকের একটি পর্যবেক্ষক বাহিনী গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মমতা। কেন্দ্রীয় ভাবে কাজ তদারকি করার জন্য মুখ্যসচিব মনোজ পন্থকে একটি ‘মনিটরিং টিম’ গঠন করার নির্দেশ দেন।

    রাস্তা, আলো, পানীয় জল, ছোট সেতুর মতো ছোট-ছোট সমস্যা সমাধানে ইতিমধ্যেই অর্থ দেওয়া হচ্ছে। মাস দুয়েকের মধ্যে তার বাস্তবায়ন চান মমতা। সে কারণেই ১০ পর্যবেক্ষকের বাহিনী গড়ে দিলেন বলে জানান তিনি। যে যে জেলা আবাস, রাস্তা, পানীয় জল সংযোগের কাজ দ্রুত ভালো ভাবে করতে পারবে, তাদের রাজ্য সরকারের তরফে পুরষ্কৃত করা হবে বলেও ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

    এদিন এসআইআর আতঙ্কে মৃতদের পরিবারের পাশে থাকার বার্তা দেন মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার নবান্নের বৈঠক থেকে আর্থিক সহযোগিতার কথা ঘোষণা করেন তিনি। এসআইআর-এর অতিরিক্ত কাজের চাপের অভিযোগে আত্মঘাতী বিএলও-দের পরিবারের জন্য ২ লক্ষ টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। বিএলওদের পাশাপাশি এসআইআর আতঙ্কে যাঁরা মারা গিয়েছেন তাঁদের পরিবারকেও ২ লক্ষ টাকার আর্থিক ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করেছেন তিনি। অসুস্থরা পাবেন ১ লক্ষ টাকা।

    এদিন বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থা নিয়েও সরব হন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মারধর, অত্যাচার থেকে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছিল, গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অনেককে আবার বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরে ফিরে আসা সেই ৩১ লক্ষ ৭২ হাজার পরিযায়ী শ্রমিককে ৫ হাজার টাকা করে অর্থ সাহায্য করা হয়েছে। তাঁদের কাজও দেওয়া হয়েছে।‘

    কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনা নিয়েও সুর চড়ান মুখ্যমন্ত্রী। কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের মোট পাওনা ১ লক্ষ ৮৭ হাজার কোটি টাকা। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে একশো দিনের কাজে বাংলার পাওনা টাকা মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। তারপরও এখনও দিল্লি পাওনা টাকা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী। ফেব্রুয়ারিতে পাওনা টাকা দিয়ে মার্চ মাসে ওই টাকা কেন্দ্র নিয়ে নিতে পারে। সেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মমতা। কেন্দ্রের চালাকি ধরা পড়ে গিয়েছে বলেও এদিন খোঁচা দেন মমতা। ‘উন্নয়নের পাঁচালি’ নিয়ে সমাজমাধ্যমে যাতে কোনও রকম অপপ্রচার না হয় তা নিয়েও এদিন কড়া বার্তা দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু তাই নয়, নজরে এলে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রশাসনিক প্রধান।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)