ভোটার তালিকা নিয়ে চলতে থাকা জটিলতা ও অভিযোগের ভিড়ের মধ্যেই আরও কঠোর পদক্ষেপে পথে হাঁটল নির্বাচন কমিশন। ভুয়ো ভোটার ও অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে এবার কৃত্রিম মেধা বা এআইকে ব্যবহার করছে কমিশন। কমিশন সূত্রের দাবি, বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর-এর পুরো প্রক্রিয়াকে আরও নিখুঁত করতে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে এআই-চালিত ডেটা বিশ্লেষণ। ফলে ভোটারদের তথ্যের সামান্য অসঙ্গতিও এবার ধরা পড়বে ‘নিখুঁত স্ক্যান’-এর আওতায়।
কমিশনের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, ‘এআই’ শব্দটি যতটা সাধারণ মনে হয়, এর কাজ ততটাই গভীরে। প্রতিটি ভোটারের নাম, ছবি, আধার নম্বর, মোবাইল নম্বর, বাবা-মায়ের নাম— সব কিছুই আলাদাভাবে স্ক্যান করা হবে। পাশাপাশি ২০০২ সালের ভোটার তালিকার সঙ্গে বর্তমান তথ্যের সামঞ্জস্য মিলিয়ে দেখা হবে। মাঝখানে হঠাৎ বাবা-মায়ের নাম বদল হলে, বয়সের অস্বাভাবিক ব্যবধান থাকলে বা পূর্ব তথ্যের সঙ্গে অসঙ্গতি দেখা দিলে সংশ্লিষ্ট ভোটারকে ডেকে পাঠানো হবে বলেও তিনি জানান। তাঁর দাবি, এই পদ্ধতিতে অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াও খুব সহজ হবে।
Advertisement
এদিকে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৪৬ লক্ষের বেশি নাম নতুন খসড়া তালিকায় নাও থাকতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। মৃত ভোটার, অন্যত্র চলে যাওয়া ব্যক্তি— সব মিলিয়ে ইতিমধ্যেই প্রায় ৯৮ হাজার ভুয়ো ভোটারকে চিহ্নিত করা গিয়েছে বলে কমিশন সূত্রের দাবি। সূত্রের খবর, প্রায় ২২ লক্ষের বেশি মৃত ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাবে। এছাড়া অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত ভোটার, ভুয়ো ভোটার মিলিয়ে আরও প্রায় ২৪ লক্ষ নাম বাদ যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে প্রতিদিন ডেটা বদলাচ্ছে। ফলে এই সংখ্যায় পরিবর্তন আসতে পারে।
এবারের এসআইআর পর্বে বিএলও-দের উপর কাজের বাড়তি চাপ নিয়ে বারবার অভিযোগ তুলছে বিরোধীরা। পূর্ব বর্ধমানে ব্রেন স্ট্রোকে, মুর্শিদাবাদে হৃদ্রোগে, জলপাইগুড়িতে ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার এবং নদিয়ায় আত্মহত্যা— সব ক্ষেত্রেই অভিযোগের তীর এসআইআর-এ কাজের চাপ নিয়ে। তবে রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে চার জন বিএলও-র মৃত্যু ঘিরে প্রশ্ন উঠলেও কমিশনের দাবি, কাজের চাপ থাকলেও তা ‘অত্যধিক’ নয়। কমিশন এই ঘটনাগুলিকে ‘দুঃখজনক’ বলেছে এবং আলাদাভাবে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। পুলিশের রিপোর্ট ও ময়নাতদন্তের নথিও চাওয়া হয়েছে।
তবে একই সঙ্গে কমিশন স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, রাজ্যে মোট ৮০,৬৮১ জন বিএলও কাজ করছেন। মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দপ্তরের দাবি, ‘কর্তব্যরত অবস্থায় মৃত্যু’র ঘটনায় ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।
তবে বিরোধী দল, বিশেষত বিজেপি অভিযোগ তুলেছে যে, বহু জায়গায় বিএলও-দের ভয় দেখিয়ে নাম বাদ বা অন্তর্ভুক্তির কাজ করানো হচ্ছে। দিল্লিতে সিইও দপ্তরে গিয়েও এই অভিযোগ জানানো হয়েছে। তবে কমিশনের বক্তব্য, নির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোনও পদক্ষেপের প্রশ্ন নেই। একই সঙ্গে বিএলও-দের উদ্দেশে কড়া সতর্কবার্তা, কোথাও কোনও ভুল এন্ট্রি থাকলে বর্ধিত এক সপ্তাহ সময়ের মধ্যেই তা শুধরে নিতে হবে। ‘ইচ্ছাকৃত’ ভুল হলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গ-সহ ১২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এসআইআর-এর দ্বিতীয় দফার কাজ চলছে। ইতিমধ্যেই প্রতিটি ধাপে নির্দিষ্ট সময়সীমা এক সপ্তাহ করে বাড়ানো হয়েছে। এনুমারেশন ফর্ম আপলোডের শেষ তারিখ ৪ ডিসেম্বর থেকে বাড়িয়ে ১১ ডিসেম্বর করা হয়েছে। কমিশনের ধারণা, কাজে যে অগ্রগতি হয়েছে, তাতে সময়সীমা আর বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। তবে এখনই কোনও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়নি।
পরিবর্তিত সূচি অনুযায়ী, আগামী ১৬ ডিসেম্বর খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। এরপর অভিযোগ, দাবি, আপত্তি জমা দেওয়ার সময় থাকবে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। ১৬ ডিসেম্বর থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুনানি হবে ইআরও-দের সামনে। প্রতিটি শুনানি সিসি ক্যামেরায় রেকর্ড করা থাকবে। আবেদনকারীকে করা প্রশ্ন থেকে দেখানো নথি, সব কিছুর উপরই নজরদারি চালাবে কমিশন।
যদিও জনতার মধ্যে এসআইআর আতঙ্ক ছড়িয়েছে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকায়। ‘ফর্ম কীভাবে পূরণ করব’, এই প্রশ্নে উদ্বেগ দেখা দিলেও কমিশন সূত্রের দাবি, অন্য বড় রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গেও অনেক বেশি গতিতে কাজ এগোচ্ছে। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামে বেশি সাড়া মিলেছে বলেও জানানো হয়েছে।