ঠান্ডা পড়তেই জমি তৈরি করে আলু চাষের প্রস্তুতি শুরু করেছেন কৃষকেরা। তবে চাষের শুরুতেই তাঁদের ভাবাচ্ছে খরচ। জুড়েছে ১ ডিসেম্বর থেকে মজুত আলু হিমঘরে রাখার বাড়তি ভাড়াও।
সোমবারই কালনার বাঘনাপাড়ার এক চাষির অপমৃত্যু হয়। পরিবারের দাবি, নিজের আড়াই বিঘা জমির সঙ্গে চুক্তিতে আরও দেড় বিঘা জমি নিয়ে ধান, আলু, আনাজ চাষ করতেন তিনি। তবে পর পর কয়েক বছর চাষে লাভ পাননি। অর্থাভাবে তিনি এ বার আলু চাষ শুরু করতেও পারছিলেন না। সেই অবসাদেই আত্মঘাতী হন, দাবি পরিবারের।
জেলায় প্রায় ৭২ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়। বেশির ভাগ চাষি জ্যোতি আলুর চাষ করেন। উৎপাদিত আলু জমি থেকে তোলার পরে চাষিদের বড় অংশ হিমঘরে মজুত রাখেন।পরে মজুত আলু বিক্রি করে অন্য চাষের খরচ জোগাড় করেন। তাঁরা জানান, ২০২২-এ আলুর ভাল দাম মিলেছিল। তার পরে লোকসান হয়েছে। ২০২৫-এ হিমঘরে বস্তা পিছু আলু মজুত করতে খরচ হয়েছে ৪৭০-৫০০ টাকা। এখন আলুর বস্তা পিছু বন্ড বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩২০ টাকায়। এর উপরে, এ বার ১ ডিসেম্বর থেকে মজুত আলু হিমঘরে রাখার জন্য দিতে হবে বাড়তি অর্থ। সাধারণত হিমঘরে আলু মজুত করা হয় ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত। এ বার হিমঘর থেকে বেশি আলু বাজারজাত না হওয়ায় থাকায় সরকার মজুতের সময়সীমা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছে। এই সময়কালে কুইন্টাল প্রতি দক্ষিণবঙ্গে ২০.২২ ও উত্তরবঙ্গে ২০.৬৬ টাকা বাড়তি দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে সরকার। বর্ধিত সময়ের জন্য অতিরিক্ত ভাড়া প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছে প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির তরফে আবেদন জানানো হয়েছে কৃষি বিপণনমন্ত্রী বেচারাম মান্না ও সচিব ওঙ্কার সিংহ মিনাকে।
প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির জেলা সদস্য আনন্দ সাঁতরা বলেন, ‘‘অসম, বিহার, ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যগুলি এক সময়ে আমাদের আলুর উপরে অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল।এখন তারা আলু চাষে অনেকটাই স্বনির্ভর। টানা চার বছর ধরে মজুত আলু হিমঘরে রেখে চাষি এবং ব্যবসায়ীদের মোটা টাকা লোকসান হচ্ছে। এ বার যে আলু ৪৭০-৫০০ টাকায় মজুত হয়েছিল, সে আলুর বন্ড বস্তা পিছু বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩২০ টাকায়। এই পরিস্থিতিতে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হিমঘরে আলু রাখার জন্য বাড়তি ভাড়া না নেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছে। পাশাপাশি, ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানোর ক্ষেত্রে পরিবহণে ভর্তুকি দিলে ভাল হয়।’’
চাষিরা জানান, এক সময়ে আলু চাষে চাঙ্গা হত গ্রামীণ অর্থনীতি। তার পরে চাষের খরচ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। চাষের সময়ে জোগাড় করতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। অনেককেই চাষের জন্য ব্যাঙ্ক, সমবায়, এমনকি মহাজনের থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। চাষে লাভ না মিললে বাড়ছে ঋণের বোঝা। মেমারির বড়া গ্রামের চাষি অরুণ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, বিঘা প্রতি জমিতে এ বার খরচ ৩৫ হাজার টাকারও বেশি। শুরুতেই খরচ করতে হবে প্রায় ২০ হাজার টাকা। চাষের পরে শ্রমিক, কীটনাশক, সারের খাতে খরচ রয়েছে। শীত বেশি দিন না থাকলেই শুরু হয় নাবি ধসার হামলা। তা ঠেকাতে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হয়।
কালনা ২ ব্লকের চাষি বাবর মোল্লার দাবি, সাধারণত বিঘা প্রতি জমিতে ৮০-৯০ বস্তা ফলন মেলে। বস্তা পিছু ৪০০ টাকা দর মিললে খরচ উঠবে। ১০ বিঘা জমিতে আলু চাষের জন্য শুরুতেই খরচ করতে হচ্ছে দু’লক্ষ টাকা। এর সিংহ ভাগই জোগাড় করতে হচ্ছে। কোনও চাষে এত খরচ নেই। লাভ মিলবে কিনা তা এখন থেকেই ভাবাচ্ছে। কালনা ১ ব্লকের নান্দাই এলাকার চাষি বাপি শেখ বলেন, ‘‘আলু চাষে লাভের নিশ্চয়তা নেই। তার থেকে অনেক কম খরচে ভাল লাভের সম্ভাবনা রয়েছে ভুট্টা চাষে। এ বার কালীনগর, গ্রামকালনা, হাতিপোতা, মির্জাপুরের মতো কিছু জায়গায় ভুট্টা চাষের এলাকা বাড়ছে। আমার ধারণা এ বার আলু চাষের এলাকা কমবে।’’
এক কৃষি বিশেষজ্ঞের কথায়,‘‘এ বার জেলায় কত পরিমাণজমিতে আলু চাষ হচ্ছে তা বলারসময় এখনও আসেনি। তবে অনিশ্চিত আলু চাষ থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ভুট্টা, শংকর প্রজাতির সর্ষে, কিছু জায়গায় ফুলের চাষের কথা মাথায় রাখতে হবে।’’